ইফতেখারুল আলম রাজু (৩৩) ও জামিলা আক্তার অর্পার (৩২) মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিন। সেই সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। বছরের ভেতরে দুজনের ঘর আলো করে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। সেই কন্যাকে নিয়েই কেটে যায় তাদের পরবর্তী সুখের একযুগ। এরইমধ্যে স্ত্রী অর্পার সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় ৩০ বছর বয়সী তানভির আহমেদ তন্ময়ের। সেই পরিচয়ও গড়ায় ভালোবাসায়। এবার প্রেমিক তন্ময়কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় অর্পা। কিন্তু তাদের এই সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ান অর্পার স্বামী।
স্ত্রীর সঙ্গে অন্য পুরুষের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি রাজু। স্ত্রীকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি লেগে থাকতো। বেপরোয়া স্ত্রীকে শায়েস্তা করতে রাজু তার গায়ে হাত তুলেন। এতেই বিগড়ে যায় অর্পা। স্বামীর করা আঘাতের চিহ্ন ছবি তুলে পাঠায় প্রেমিকের কাছে। এতে করে প্রেমিক তন্ময়ও ক্ষেপে যায়। তখন স্বামীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরামর্শ করে প্রেমিকের সঙ্গে। ধানমণ্ডি লেকে বসেই স্বামী হত্যার রেকি করে। সঙ্গে ছিল প্রেমিক তন্ময়। হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করতে ১ লাখ টাকায় ভাড়া করা হয় নূরে আলম হোসেন নূরকে। তারপর থার্টিফার্স্ট নাইটে রাজুর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসার সামনে তাকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তারা। পরেরদিন সকালে বাসার নিচতলায় প্রেমিক তন্ময় নিজেই রাজুকে উদ্দেশ্য করে দুটি গুলি চালায়। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান রাজু। দুটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ভাড়াটে কিলার নূরের চাকুর আঘাত রাজুর বাম হাতের কনুইতে লাগে। প্রতিবেশীর সহযোগিতায় ১৬টি সেলাই ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে রাজু সুস্থ হয়ে উঠেন।
স্ত্রী ও তার প্রেমিক তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে এটি জানতেন না রাজু। চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি আহত হয়ে তিনি খিলগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের একটি টিম রাজুর স্ত্রী অর্পার মোবাইল ঘেঁটে তন্ময় নামের এক যুবকের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এমন সত্যতা পান। মেসেঞ্জারে ও কললিস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করেই ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তাকে সন্দেহ করেন। এ ছাড়া থানায় মামলার পর থেকেই অর্পা তার স্বামীকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলো। তার বিকাশ নম্বর থেকে তন্ময়কে টাকা পাঠানোর তথ্য পেয়েই তদন্ত সংশ্লিষ্ট নিশ্চিত হন এ ঘটনার সঙ্গে অর্পা জড়িত। পরে ডিবি প্রথমে অর্পা ও ভাড়াটে কিলার নূরকে গ্রেপ্তার করে। ৪ঠা মার্চ রাতে নূরকে রাজধানীর হাজারীবাগ ও ৭ই মার্চ অর্পাকে গেণ্ডারিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে। তারা দুজনেই আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। এদিকে অর্পা গ্রেপ্তার হয়েছে এমন খবর পেয়ে প্রেমিক তন্ময় ফের রাজুকে হত্যার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ বনশ্রীর বাসার সামনে ওত পেতে থাকে। পরে ডিবি সদস্যরা তন্ময়কে সেখান থেকেই পিস্তল ও দুই রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করেন।
ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অর্পার বাবার বাড়ি ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। তার স্বামী রাজু নিক্কি থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড কোম্পানির একজন কর্মী। পাশাপাশি অর্পার ভাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গরুর খামারের ব্যবসা করেন। দক্ষিণ বনশ্রীতে অর্পার বাবার নামে কেনা একটি ফ্ল্যাটে ১২ বছরের মেয়েকে নিয়ে তারা থাকতেন। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ফেসবুকে তন্ময়ের সঙ্গে অর্পার পরিচয় হয়। ২০২০ সালে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। একপর্যায়ে তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্পার স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না। এটি তার পরিবারের সদস্যরাও জানতেন। তার প্রেমিক তন্ময়ের বাড়ি কুমিল্লা। সে বাংলালিংক মোবাইল কোম্পানিতে ছোটখাটো চাকরি করে। তাদের দুজনের সম্পর্কের বিষয়টি রাজুর কাছে ফাঁস হয়ে যায়। এরপর থেকে রাজু ও অর্পার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। প্রায়ই রাজু স্ত্রী অর্পাকে মারধর করতো। অর্পা মারধরে সৃষ্ট আঘাতের চিহ্ন মোবাইলে ছবি তুলে তন্ময়কে পাঠাতো। প্রেমিকাকে মারধর করা হচ্ছে এটিকে স্বাভাবিকভাবে তন্ময়ও নিতে পারেনি। দুজনের মনের ভেতর জিদ চাপে। প্রথমদিকে রাজুকে ডিভোর্স দিয়ে তন্ময়কে বিয়ের পরিকল্পনা থাকলেও মারধরের কারণে সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে যায় অর্পার। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে অর্পা, তন্ময় মিলে ধানমণ্ডি লেকে বসে কয়েকবার বৈঠক করে। তারা রাজুকে হত্যা করে উচিত শিক্ষা দেয়ার পুরোপুরি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। মিশন বাস্তবায়ন করার জন্য ১ লাখ টাকায় পটুয়াখালী এলাকার বাসিন্দা নূরকে ভাড়া করে। টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অর্পা নিজের স্বর্ণ বন্ধক দেয়। সেই টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা তুলে দেয় তন্ময়ের কাছে। তন্ময় ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় কুমিল্লা থেকে একটি পিস্তল সংগ্রহ করে। তারপর গত বছরের ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১২টার পর প্রথম অভিযান চালায়।
ভুক্তভোগী ও অর্পার স্বামী রাজু জানিয়েছেন, ওই রাতে দক্ষিণ বনশ্রীর ৯/৩ নম্বর রোডের ই ব্লকের ১৫৯ নম্বর বাসায় গেইট খুলে বাসায় প্রবেশের সময় মুখে মাস্ক পরা অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার বাসায় রাতযাপন করতে চায়। রাজি না হওয়াতে ওই ব্যক্তি চলে যায়। পরদিন সকাল সাড়ে ৮টায় তার মুন্সীগঞ্জের গরুর খামার পরিদর্শনে যাবার জন্য বাসা থেকে বের হলে অস্ত্রধারী দুজন হামলা করে। এ সময় তারা দুই রাউন্ড গুলি ছুড়লেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরে একজন তাকে চাকু দিয়ে জখম করে পালিয়ে যায়।
ডিবি’র মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পরকীয়া সম্পর্কের কথা জানতে পেরে রাজু তার স্ত্রীকে মারধর করতো। স্ত্রী আবার মারধরের বিষয়টি তার প্রেমিক তন্ময়কে জানাতো। দুজনের ভেতরে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষোভ থেকেই তারা দুজন মিলে রাজুকে হত্যার ছক কষে। তিনি বলেন, প্রথমদিকে ঘটনাটি বেশ ক্লুলেস ছিল। তথ্য প্রযুক্তি ও গভীর তদন্তে আমরা এর পেছনে রাজুর স্ত্রীর জড়িত থাকার বিষয়টি টের পাই। পরে তাকে গ্রেপ্তার করি। প্রেমিকা গ্রেপ্তার হয়েছে এই খবর শুনে তন্ময় আবার রাজুকে হত্যার উদ্দেশ্যে একই পিস্তল নিয়ে আসে। পরে আমরা তাকে পিস্তলসহ গ্রেপ্তার করেছি। আগের মামলা ছাড়াও তন্ময়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে।
ডিবি’র মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আমরা তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি। তাদের মধ্যে দু’জন আদালতে তাদের দোষ স্বীকার করেছে। যে পিস্তল দিয়ে শুট করা হয়েছিল সেই পিস্তল আমরা প্রেমিক তন্ময়ের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি। তন্ময় আমাদেরকে জানিয়েছে, তার প্রেমিকার স্বামী রাজুকে খুন করার জন্য ভাড়া করে পিস্তল সংগ্রহ করেছে। সুত্র: দৈনিক মানবজমিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।