আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, সংক্ষেপে আইসিজে) রোহিঙ্গা জেনোসাইড আড়াল করার শত চেষ্টা করেও পার পাচ্ছে না মিয়ানমার। রোহিঙ্গা জেনোসাইডের জবাবদিহির বিষয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গা জেনোসাইড মিয়ানমারের পিছু ছাড়ছে না। বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আদালতে ছুটতে হবে। কয়েক প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারকে এই জেনোসাইডের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে।
এদিকে আইসিজেতে শুনানিতে অংশ নেওয়ার পর ডাচ্ আইন প্রণেতাদের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে গতকাল শনিবার নেপিডোতে ফিরেছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর জেনোসাইড চালানোর অভিযোগের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার জন্য গত শুক্রবার ডাচ্ পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সঙ্গে সু চির বৈঠক নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে সু চি সেই বৈঠক বাতিল করেন। অবশ্য এর আগেই গত মঙ্গলবার ডাচ্ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইডের মামলার উদ্যোগকে সমর্থন জানায়। রোহিঙ্গা জেনোসাইড নিয়ে সু চি আইসিজেতে মিথ্যাচার করে দেশে ফেরার পর দলের সমর্থকদের ব্যাপক সংবর্ধনা পেয়েছেন।
মিয়ানমারের নির্বাসিত মানবাধিকারকর্মী মং জার্নি বলেছেন, ‘সু চি আইসিজেতে প্রমাণ করেছেন তিনি মিয়ানমারে পুতুল নন। অস্বীকার করা যায় না এমন সব অপরাধকে তিনি আবেগ দিয়ে অস্বীকার করেছেন। তিনি পুরোপুরি দোষী। তিনিও ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়েছেন।’
মং জার্নি আরো বলেন, ‘অং সান সু চি কেবল মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকেই সমর্থন করেননি, তিনি সেখানে রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার ও এর জাতিবিদ্বেষী সমাজকে সমর্থন করেছেন।’
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা আগেই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের দায় সু চি এড়াতে পারেন না।
বর্তমানে আইসিজে ছাড়াও রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নসহ গুরুতর অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট, সংক্ষেপে আইসিসি) এবং জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কাঠামোতে উদ্যোগ চলমান রয়েছে। আইসিজেতে জেনোসাইডবিরোধী সনদ লঙ্ঘন ও রোহিঙ্গা জেনোসাইডের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় অন্তর্বর্তী আদেশ নিয়ে শুনানি গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে। আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি রায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
জেনোসাইডের দায়ে মিয়ানমারকে আইসিজেতে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে গাম্বিয়ার প্রচেষ্টার প্রতি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) অপর ৫৬টি দেশের সমর্থন আছে। এ ছাড়া কানাডা ও নেদারল্যান্ডস বিবৃতি দিয়ে ওই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আনুষ্ঠানিক বিবৃতি বা প্রকাশ্যে ঘোষণা না দিয়েও রোহিঙ্গা জেনোসাইডের দায়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করানোর ব্যাপারে আরো অনেক পশ্চিমা দেশের সমর্থন আছে। কৌশলগত কারণে ওই দেশগুলো এখনই প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দিচ্ছে না।
এদিকে আইসিজেতে গত সপ্তাহের শুনানিতে মিয়ানমারের ‘খোঁড়া’ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশের ব্যাপারে জবাবদিহির পক্ষের লোকজনের প্রত্যাশা বেড়েছে। আইসিজে যদি অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন মঞ্জুর করে মিয়ানমারকে সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্যোগ নেওয়ার আদেশ দেন তবে তা এই মামলার পরবর্তী ধাপ এবং অন্যান্য মামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আইসিজে গাম্বিয়ার অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন মঞ্জুর করলে তা হবে মিয়ানমারের জন্য বড় ধাক্কা। আইসিজের সদস্য রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র তখন ওই আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে পারে এমন ইঙ্গিত মিলছে।
জানা গেছে, গাম্বিয়া ও মিয়ানমার—উভয় পক্ষের প্রস্তুতির পর আইসিজেতে জেনোসাইড মামলা নিয়ে পূর্ণ শুনানি শুরু হবে। এটি শেষ হতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা বলছেন, আইসিজেতে রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের ব্যক্তি পর্যায়ের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে ভূমিকা আইসিসি রাখতে পারে। মিয়ানমার রোম সংবিধির সদস্য নয়। মিয়ানমার এ অজুহাত তুলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আইসিসির বিচারিক এখতিয়ার অস্বীকার করলেও আইসিসি বলেছে, অপরাধের একটি অংশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে নির্বাসিত হয়ে বাংলাদেশে (রোম সংবিধির সদস্য) প্রবেশের মাধ্যমে সংঘটিত হওয়ায় আইসিসি এখানে বিচারিক এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে।
আইসিসির প্রাক-বিচারিক আদালত-৩ গত মাসে এক আদেশে কৌঁসুলির দপ্তরকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, নিপীড়নসহ অন্যান্য নির্যাতনের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনো অপরাধ তদন্তের অনুমতি দিয়েছেন। জানা গেছে, আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর তদন্ত শুরু করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিমধ্যে আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তরের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আনুষ্ঠানিক তদন্ত, তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর ঢাকা ও কক্সবাজারে অফিস খুলবে। এ ছাড়া আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তরের একটি প্রতিনিধিদল শিগগিরই ঢাকা সফর করবে।
তদন্তের পরবর্তী ধাপ কী—এ প্রশ্নের জবাবে আইসিসির পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ইউনিট বলেছে, ‘নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন উৎস থেকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠুভাবে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে যত সময় লাগবে ততদিন ধরে তদন্ত চলতে থাকবে। নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের অপরাধের জন্য দায়ী প্রমাণে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট প্রমাণাদি সংগৃহীত হলে প্রাক-বিচারিক আদালত-৩-এর বিচারকদের উপস্থিতিকে কৌঁসুলি সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য অনুরোধ করবেন।’
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভবিষ্যতে উপযুক্ত যেকোনো দেশীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের জন্য রোহিঙ্গা নিপীড়নের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করছে জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কাঠামো। মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী মিশনের সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত ওই কাঠামো নিজের হেফাজতে নিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমারের বিচারে এখন কিছু দেশের আপত্তি থাকলেও ভবিষ্যতে সব সময় একই পরিস্থিতি থাকবে এমন নয়। ভবিষ্যতে কোনো দিন মিয়ানমার এবং তার অপরাধীদের বিচারের জন্য তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কাঠামো কাজ করছে। ভবিষ্যতে উপযুক্ত কোনো সময়ে ওই কাঠামোই উপযুক্ত কোনো আদালতে মামলা দায়ের করবে। এর বাইরেও মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার এবং মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তর ও এর কর্মকর্তারা মিয়ানমার পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি রাখছেন। তাঁরাই জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে তাঁদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করছেন। এগুলোও ভবিষ্যতে মিয়ানমারের জবাবদিহির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।