রেহানা সাহা (৫২) ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসবাস করেন। গত বছর ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর তাঁর মনে হয়েছিল, জীবনের সব স্বাদ যেন হারিয়ে গেল। মিষ্টি, ভাত, ফল— প্রিয় খাবারগুলো কি চিরতরে ছেড়ে দিতে হবে? ভয় আর অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন তিনি। কিন্তু একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শে তৈরি করা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে। আজ তিনি জানেন, কোন খাবার কখন, কতটুকু খাবেন। নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস আর ওষুধের সমন্বয়ে তাঁর রক্তের শর্করা এখন স্থিতিশীল। রেহানা সাহার মতো লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাসই হলো সুস্থতা ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার মূলমন্ত্র। শুধু ওষুধ নয়, বরং প্রতিদিনের প্লেটে কী রাখছেন সেটিই নির্ধারণ করবে আপনার শর্করার মাত্রা, জটিলতা এড়ানোর সম্ভাবনা এবং সামগ্রিক সুস্থতা। এটি কোনো কঠোর বিধি-নিষেধের তালিকা নয়, বরং একটি বিজ্ঞানসম্মত ও টেকসই জীবনবোধের রূপান্তর।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান: কেন এটি অপরিহার্য?
ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্টে ওষুধের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ডায়েট হলো সেই ভিত্তি যার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে রোগ নিয়ন্ত্রণের পুরো কাঠামো। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেছে, দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান শুধু রক্তের গ্লুকোজই কমায় না, এটি:
- ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: বাড়তি ওজন টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রধান চালিকাশক্তি। সঠিক ডায়েট ওজন কমাতে বা স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করে।
- রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে: ডায়াবেটিসের সাথে প্রায়শই হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি জড়িত। স্বাস্থ্যকর ডায়েট এই ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।
- শক্তি প্রদান করে ও ক্লান্তি দূর করে: সঠিক সময়ে সঠিক খাবার গ্রহণ রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় রেখে সারাদিন সতেজ ও কর্মক্ষম রাখে।
- জটিলতা প্রতিরোধ করে: কিডনি রোগ, চোখের ক্ষতি (রেটিনোপ্যাথি), স্নায়ুর ক্ষতি (নিউরোপ্যাথি) এবং পায়ের আলসার ইত্যাদি মারাত্মক জটিলতা এড়াতে সাহায্য করে।
- মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়: রক্তে শর্করা স্থিতিশীল থাকলে মেজাজের ওঠানামা কমে, উদ্বেগ ও বিষণ্নতার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠানের মতে, “বাংলাদেশে ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো খাদ্যাভ্যাসের ভুল ধারণা। অনেকে মনে করেন ডায়াবেটিস মানেই ভাত ছাড়া জীবন। এটি সম্পূর্ণ ভুল। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান এর মূল উদ্দেশ্য হলো পরিমিত ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, ক্ষুধার্ত থাকা নয়।”
ডায়াবেটিস ডায়েটের মৌলিক নীতিমালা: কী খাবেন, কীভাবে খাবেন?
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান জটিল কিছু নয়। এর মূল ভিত্তি হলো কিছু সহজবোধ্য কিন্তু অত্যন্ত কার্যকরী নীতি মেনে চলা:
- কার্বোহাইড্রেটের বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ বাছাই ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ: কার্বোহাইড্রেট রক্তে শর্করায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই এর ধরন ও পরিমাণ জানা জরুরি।
- জটিল কার্বোহাইড্রেটকে অগ্রাধিকার দিন: লাল চালের ভাত (বাসমতি, কাটারিভোগ), ওটস, বার্লি, ঢেঁকিছাটা আটা বা গমের রুটি, হোল হুইট ব্রেড, ডাল, শিম জাতীয় সবজি (যেমন: শিম, বরবটি, মটরশুঁটি)। এগুলো আঁশসমৃদ্ধ, ধীরে ধীরে হজম হয় এবং রক্তে শর্করা ধীরে বাড়ায়।
- সরল কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে চলুন বা সীমিত করুন: সাদা চালের ভাত, সাদা ময়দার রুটি, পরটা, লুচি, চিনি, মিষ্টি, কোমল পানীয়, মিষ্টি ফলের রস। এগুলো রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়।
- পরিমিতি বুঝুন: ভাত/রুটির পরিমাণ কমিয়ে আনুন। এক বেলা ১ কাপ (২৫০ মিলি মাপের কাপে) রান্না করা লাল চালের ভাত বা ১টি মাঝারি আকারের আটার রুটি যথেষ্ট। প্লেটের অর্ধেক রাখুন শাকসবজি দিয়ে, এক চতুর্থাংশ প্রোটিন (মাছ/মাংস/ডাল) এবং বাকি এক চতুর্থাংশ কার্বোহাইড্রেট (ভাত/রুটি)।
- আঁশ (ফাইবার) সমৃদ্ধ খাবার বাড়ান: আঁশ রক্তে শর্করা শোষণের গতি কমায়, হজমশক্তি বাড়ায় এবং পেট ভরা রাখে।
- প্রচুর শাকসবজি খান (পালং শাক, লাল শাক, ডাঁটাশাক, লাউশাক, ঢেঁড়স, বেগুন, শসা, টমেটো, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, ফুলকপি ইত্যাদি)। প্রতিবেলা প্লেটে অন্তত দু’রকম সবজি রাখার চেষ্টা করুন।
- ফলমূল খান, তবে পরিমিত (দিনে ১-২ বার, মাঝারি আকারের একটি ফল যেমন: আপেল, পেয়ারা, জাম্বুরা, কমলালেবু)। খুব মিষ্টি ফল (আম, কলা, লিচু, আঙুর, তরমুজ) পরিমাণে কম খাবেন এবং অন্যান্য খাবারের সাথে না খেয়ে আলাদা সময়ে (যেমন সকালের নাস্তা ও বিকেলের নাস্তার মাঝে) খাওয়া ভালো।
- ডাল, বাদাম, বিচি (কুমড়ার বিচি, সূর্যমুখী বিচি) আঁশের ভালো উৎস।
- লিন প্রোটিনের উৎস বেছে নিন: প্রোটিন পেশি গঠন করে, ক্ষুধা কমায় এবং রক্তে শর্করা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
- মাছ (সামুদ্রিক মাছ ও চর্বিহীন মিঠাপানির মাছ) প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস। সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন মাছ খান।
- মুরগির মাংস (ছাল ছাড়া), ডিমের সাদা অংশ।
- ডাল, বিনস, টফু, ছানা, দই (চিনি ছাড়া)।
- লাল মাংস (গরু, খাসি) সীমিত পরিমাণে খাবেন (সপ্তাহে ১ বার) এবং চর্বি ফেলে দিয়ে রান্না করবেন।
- সুস্বাস্থ্যকর চর্বি (Healthy Fats) নির্বাচন করুন: চর্বি খারাপ নয়, খারাপ চর্বি খারাপ।
- অসম্পৃক্ত চর্বিকে অগ্রাধিকার দিন: সরিষার তেল, সয়াবিন তেল (সীমিত), রাইস ব্র্যান অয়েল, জলপাইয়ের তেল, ক্যানোলা অয়েল।
- বাদাম (আখরোট, আমন্ড, কাজু – তবে পরিমিত), বিচি।
- এভোকাডো (যদি পাওয়া যায়)।
- সম্পৃক্ত চর্বি (ঘি, মাখন, ডালডা, নারকেল তেল, পাম অয়েল) এবং ট্রান্স ফ্যাট (বেকারি পণ্য, ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার) সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলুন বা অত্যন্ত সীমিত করুন।
- নিয়মিত সময়মতো খাবার গ্রহণ: ৩ বেলা প্রধান খাবার (সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার) এবং ২-৩ বার হালকা স্বাস্থ্যকর নাস্তা (যেমন: এক মুঠো বাদাম, একটি ফল, এক কাপ টক দই) খাওয়া জরুরি। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে রক্তে শর্করা বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) আবার পরবর্তীতে বেশি খেয়ে ফেললে তা দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। সময়মতো খাওয়া রক্তে শর্করার ওঠানামা কমায়।
- পর্যাপ্ত পানি পান: দিনে ৮-১০ গ্লাস (২-২.৫ লিটার) পানি পান করুন। চিনিযুক্ত পানীয়, ফলের রস, এনার্জি ড্রিঙ্কস এড়িয়ে চলুন। পানিই হল সবচেয়ে ভালো পানীয়। লেবু পানি (চিনি ছাড়া), ডাবের পানি (পরিমিত) ভালো বিকল্প।
- খাবারের অংশ (Portion Size) নিয়ন্ত্রণ: কী খাচ্ছেন তার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় কতটা খাচ্ছেন। প্লেট ছোট করুন। খাবার ভালো করে চিবিয়ে ধীরে ধীরে খান। এতে পেট ভরা বোধ দ্রুত হয় এবং অতিরিক্ত খাওয়া কমে।
- খাদ্য লেবেল পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন: প্যাকেটজাত খাবার কিনলে পুষ্টি তালিকা (Nutrition Facts) অবশ্যই দেখুন। চিনি (Sugar), সোডিয়াম (Sodium), সম্পৃক্ত চর্বি (Saturated Fat) এবং ট্রান্স ফ্যাট (Trans Fat) এর পরিমাণ লক্ষ্য করুন। মোট কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ এবং ফাইবারের পরিমাণ দেখুন।
শর্করা গণনা (Carb Counting) সহজ পদ্ধতি
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচের টেবিলটি সাধারণ খাবারের আনুমানিক কার্বোহাইড্রেট পরিমাণ বোঝাতে সাহায্য করবে:
খাদ্য আইটেম | পরিমাণ | আনুমানিক কার্বোহাইড্রেট (গ্রাম) | মন্তব্য |
---|---|---|---|
ভাত (সিদ্ধ লাল চাল) | ১ কাপ (১৮০ গ্রাম) | ৪৫ | ঢেঁকিছাটা/ব্রাউন রাইস ভালো বিকল্প |
রুটি (গমের আটা) | ১ টি (৩০ গ্রাম) | ১৫ | হোল হুইট বা মাল্টিগ্রেন রুটি পছন্দ করুন |
পরোটা (সাদা আটা) | ১ টি মাঝারি | ৩০-৩৫ | এড়িয়ে চলাই ভালো, বা খুব কম খান |
ওটস (শুকনো) | ১/২ কাপ (৪০ গ্রাম) | ২৭ | দ্রবণীয় আঁশ সমৃদ্ধ, ভালো ব্রেকফাস্ট |
ডাল (সিদ্ধ মুসুর/মসুর) | ১ কাপ (২০০ গ্রাম) | ৪০ | প্রোটিন ও ফাইবারের ভালো উৎস |
আলু (সিদ্ধ) | ১ টি মাঝারি (১৫০ গ্রাম) | ৩০ | সীমিত পরিমাণে খান, অন্যান্য কার্বের সাথে হিসাব করুন |
কলা | ১ টি মাঝারি | ৩০ | উচ্চ শর্করা, পরিমিত খান |
আপেল | ১ টি মাঝারি | ২৫ | আঁশ সমৃদ্ধ, ভালো পছন্দ |
দুধ (গরু) | ১ কাপ (২৫০ মিলি) | ১২ | লো-ফ্যাট দুধ বেছে নিন |
দই (সাদা, টক) | ১ কাপ (২৫০ গ্রাম) | ৮-১০ | প্রোবায়োটিকের ভালো উৎস, চিনি ছাড়া |
(তথ্যসূত্র: ইউএসডিএ ফুডডাটা সেন্ট্রাল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিজম (বিআইআরডিইএম) এর পুষ্টি নির্দেশিকা)
বাস্তব অভিজ্ঞতা: খুলনার আব্দুর রহিম (৬০) প্রায় দশ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তিনি বলেন, “আগে ভাবতাম ডায়াবেটিস মানেই ভাত খাওয়া বন্ধ। মাপজোখ না জেনে শুধু কম খেতাম, দুর্বল লাগত। একজন ডায়েটিশিয়ান আমাকে শেখালেন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান মানে শুধু কম খাওয়া নয়, বরং সঠিক খাবার বেছে নেওয়া। এখন লাল ভাত খাই, তবে এক কাপের বেশি না। প্রচুর সবজি আর মাছ খাই। ফল খাই বিকেলে। রক্তের শর্করা এখন অনেক নিয়ন্ত্রণে।”
ডায়াবেটিস বান্ধব সপ্তাহিক ডায়েট চার্টের নমুনা (বাংলাদেশি খাবারের সাথে মানানসই)
এটি একটি সাধারণ নমুনা। প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা, ওজন, কার্যকলাপের মাত্রা, ওষুধ এবং রক্তে শর্করার মাত্রার উপর ভিত্তি করে ডায়েট প্ল্যান ব্যক্তিগতকৃত হওয়া উচিত। একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান বা পুষ্টিবিদের সাথে পরামর্শ করে নিজের জন্য উপযোগী প্ল্যান তৈরি করুন।
সকালের নাস্তা (সকাল ৮:০০ – ৯:০০):
- সোম, বুধ, শুক্র: ১ কাপ ওটস (দুধ/পানিতে রান্না) + ১ টেবিল চামচ চিয়া সিড/ফ্ল্যাক্সসিড + ১/২ কাপ কাটা পেয়ারা/আপেল।
- মঙ্গল, শনি: ২ টি সিদ্ধ ডিম (সাদা অংশ বেশি) + ১ টি আটার রুটি + ১ কাপ শসা-টমেটোর সালাদ (অলিভ অয়েল-লেবুর রস দিয়ে)।
- রবি, বৃহস্পতি: ১ কাপ ছোলার ডালের স্যুপ + ১ টুকরো লাল আটার টোস্ট।
মধ্য সকালের নাস্তা (সকাল ১১:০০ – ১১:৩০):
- ১ টি মাঝারি আকারের ফল (যেমন: জাম্বুরা, কমলা, আপেল) অথবা ১ মুঠো কাঁচা বাদাম (আমন্ড/আখরোট)।
দুপুরের খাবার (দুপুর ১:৩০ – ২:৩০):
- সোম, বৃহস্পতি: ১ কাপ লাল চালের ভাত + ১ টুকরো (৮০-১০০ গ্রাম) মাছ (রুই/কাতলা/ইলিশ – তেল কম) + ১ কাপ সবজি (ঢেঁড়স/লাউ/পালং) + ১ কাপ ডাল।
- মঙ্গল, শুক্র: ১ কাপ লাল চালের ভাত + মুরগির বোনলেস কারি (১ টুকরো, তেল কম) + ১ কাপ মিক্সড সবজি স্টার ফ্রাই + ১ বাটি টক দই (চিনি ছাড়া)।
- বুধ, শনি: ১ কাপ লাল চালের ভাত + শাক (পালং/লাল) + ১ টুকরো মাছ/ডিমের কারি + ডাল।
- রবি: ১ কাপ লাল চালের ভাত + সবজি খিচুড়ি (ডাল, কম তেলে রান্না) + ১ টুকরো মাছ/চিকেন।
বিকেলের নাস্তা (বিকেল ৪:৩০ – ৫:০০):
- ১ কাপ টক দই (চিনি ছাড়া) + ১ চা চামচ ফ্ল্যাক্সসিড অথবা ছোলা ভাজা (অল্প) অথবা ১ টি সিদ্ধ ডিম অথবা ১ টি ফল।
রাতের খাবার (রাত ৮:০০ – ৮:৩০):
- সোম, বৃহস্পতি: ১ কাপ লাল চালের ভাত + ১ কাপ সবজি তরকারি (বেগুন/ক্যাপসিকাম/ফুলকপি) + ১ কাপ ডাল।
- মঙ্গল, শুক্র: ১ টি আটার রুটি + ১ কাপ মুরগির ঝোল/সবজি কারি (তেল কম) + সালাদ।
- বুধ, শনি: ১ কাপ লাল চালের ভাত + শাক (ডাঁটা/কলমি) + ১ টুকরো মাছ/ডাল।
- রবি: ১ কাপ লাল চালের ভাত + সবজি খিচুড়ি (ডাল, কম তেলে রান্না) অথবা ১ কাপ নুডুলস (সবজি সমৃদ্ধ, তেল কম)।
রাতের নাস্তা (ঘুমানোর ১-২ ঘণ্টা আগে, শুধু প্রয়োজন হলে):
- ১ গ্লাস লো-ফ্যাট দুধ (চিনি ছাড়া) অথবা এক মুঠো বাদাম (যদি রক্তে শর্করা কমে যাওয়ার ইতিহাস থাকে বা নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণ করেন)।
গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- সবজি: দুপুর ও রাতের খাবারে প্রচুর পরিমাণে নন-স্টার্চি শাকসবজি (সবুজ পাতা, লাউ, ঝিঙে, পেঁপে, শসা, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি) খান। স্টার্চি সবজি (আলু, মিষ্টি আলু, কচু, ভুট্টা) কার্বোহাইড্রেট হিসেবে গণ্য করে পরিমাণে সীমিত রাখুন।
- ডাল: প্রোটিন ও ফাইবারের ভালো উৎস। প্রতিদিন অন্তত এক বেলা খান।
- মসলা: হলুদ, দারুচিনি, মেথি, জিরা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক বলে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে। স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করুন।
- রান্নার পদ্ধতি: ভাজা-পোড়া (ডিপ ফ্রাই) এড়িয়ে সিদ্ধ, গ্রিল, বেক, স্টিম বা কম তেলে হালকা ভুনা (স্টার ফ্রাই) পদ্ধতিতে রান্না করুন।
- লবণ: অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়ায়। দিনে ১ চা চামচ (৫ গ্রাম) এর বেশি লবণ খাবেন না। প্রক্রিয়াজাত খাবার, আচার, সসে লবণ বেশি থাকে।
ডায়াবেটিসে ভুল ধারণা দূর করুন: মিথ বনাম বাস্তবতা
ডায়াবেটিস নিয়ে প্রচুর ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যা ডায়েট প্ল্যান বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে। আসুন সেগুলো কাটিয়ে উঠি:
মিথ: ডায়াবেটিস হলে ভাত/রুটি একদম খাওয়া যাবে না।
বাস্তবতা: ভাত বা রুটি খাওয়া যাবে, তবে সাদা চাল/ময়দার পরিবর্তে লাল চাল/গমের আটা বা ঢেঁকিছাটা আটা ব্যবহার করতে হবে এবং পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য জরুরি শক্তির উৎস।মিথ: ডায়াবেটিস রোগীরা ফল খেতে পারবে না।
বাস্তবতা: ফল খাওয়া যাবে, তবে পরিমাণ এবং ধরন গুরুত্বপূর্ণ। পেয়ারা, জাম্বুরা, কমলা, আপেল, পেয়ারা, বরই, আমড়া ভালো পছন্দ। খুব মিষ্টি ফল (পাকা আম, কলা, লিচু, আঙুর) অল্প পরিমাণে খেতে হবে এবং অন্য কার্বোহাইড্রেটের সাথে হিসাব করে খেতে হবে। খাবারের ঠিক পরপর ফল না খেয়ে নাস্তার সময় খাওয়া ভালো।মিথ: ডায়াবেটিসের বিশেষ খাবার বা ‘সুগার ফ্রি’ লেবেলযুক্ত খাবার খাওয়া নিরাপদ।
বাস্তবতা: অনেক ‘সুগার ফ্রি’ বা ‘ডায়াবেটিক’ খাবার (বিস্কুট, জ্যাম, চকলেট) রক্তে শর্করা বাড়াতে পারে। এতে চিনির বদলে কৃত্রিম মিষ্টি বা অন্যান্য কার্বোহাইড্রেট (যেমন মাল্টোডেক্সট্রিন) ব্যবহার করা হয় যা শর্করা বাড়াতে পারে। এছাড়া এগুলোতে চর্বি ও ক্যালরি বেশি থাকতে পারে। খাদ্য লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং এগুলো অল্প পরিমাণে খান বা এড়িয়ে চলুন।মিথ: ডায়াবেটিস হলে বেশি বেশি প্রোটিন (মাংস, ডিম) খেতে হবে।
বাস্তবতা: প্রোটিন শরীরের জন্য প্রয়োজন, তবে অতিরিক্ত প্রোটিন, বিশেষ করে লাল মাংস কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। পরিমিত ও লিন প্রোটিন উৎস (মাছ, মুরগি, ডাল, বিনস) বেছে নিন।- মিথ: ইনসুলিন নিলে যা খুশি খাওয়া যায়।
বাস্তবতা: ইনসুলিন ডোজ নির্ভর করে আপনি কী খাচ্ছেন তার উপর। খাওয়ার আগে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ না জেনে ইনসুলিন নিলে রক্তে শর্করা বিপজ্জনকভাবে কমে (হাইপো) বা বেড়ে (হাইপার) যেতে পারে। ইনসুলিন ব্যবহারকারীদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া এবং কার্বোহাইড্রেট গণনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) পুষ্টি বিভাগের প্রধান ডা. শামীম আহমেদ বলেন, “ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে বড় শত্রু হলো অজ্ঞতা ও ভুল তথ্য। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান এর সঠিক জ্ঞান এবং একজন পেশাদার পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়াই হলো দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার চাবিকাঠি।”
ডায়াবেটিস ডায়েটের সাথে শারীরিক পরিশ্রম: অপরিহার্য যুগলবন্দী
ডায়েট প্ল্যান এর পাশাপাশি নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অপরিহার্য অঙ্গ। ব্যায়াম:
- ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়: শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে, ফলে রক্তে শর্করা কমে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
- মানসিক চাপ কমায় এবং ঘুমের উন্নতি ঘটায়।
ব্যায়ামের ধরন
- এ্যারোবিক ব্যায়াম: দ্রুত হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, নাচ। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মধ্যম মাত্রার (যেমন: হাঁটার সময় কথা বলতে সামান্য কষ্ট হবে) বা ৭৫ মিনিট জোরালো মাত্রার এ্যারোবিক ব্যায়াম করুন। (যেমন: সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট করে দ্রুত হাঁটা)।
- শক্তি প্রশিক্ষণ (Strength Training): শরীরের পেশি শক্তিশালী করে। পেশি বেশি ক্যালরি পোড়ায়, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। সপ্তাহে ২-৩ দিন হালকা ওজন বা শরীরের ওজন ব্যবহার করে ব্যায়াম করুন (স্কোয়াট, লাঞ্জ, পুশ-আপ, ডাম্বেল কার্ল)।
- নমনীয়তা ও ভারসাম্য ব্যায়াম: স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম, তাই চি। আঘাত প্রতিরোধ করে এবং সার্বিক সুস্থতা বাড়ায়।
সতর্কতা
- ব্যায়াম শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, বিশেষ করে যদি হার্টের সমস্যা, চোখের সমস্যা (রেটিনোপ্যাথি), পায়ের অসাড়তা (নিউরোপ্যাথি) বা অন্য কোনো জটিলতা থাকে।
- ব্যায়ামের আগে ও পরে রক্তে শর্করা মাপুন (যদি সম্ভব হয়)।
- যদি রক্তে শর্করা খুব বেশি (>২৫০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) বা খুব কম (<১০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) থাকে, ব্যায়াম করবেন না।
- ব্যায়ামের সময় পানি পান করুন।
- আরামদায়ক জুতা পরুন এবং ব্যায়ামের পরে পা পরীক্ষা করুন (কোনো কাটা, ঘা আছে কিনা)।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. ডায়াবেটিস রোগীরা কি মিষ্টি আলু খেতে পারবেন?
হ্যাঁ, খেতে পারবেন, তবে পরিমিত পরিমাণে এবং হিসাব করে। মিষ্টি আলুতে সাধারণ আলুর চেয়ে কিছুটা কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) থাকতে পারে এবং এতে ফাইবার, ভিটামিন এ ও পটাশিয়াম বেশি থাকে। তবে এটিও একটি স্টার্চি সবজি/কার্বোহাইড্রেট উৎস। তাই এক বেলায় মিষ্টি আলু খেলে ভাত/রুটির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। ছোট একটি মিষ্টি আলু (প্রায় ৬০-৮০ গ্রাম) খাওয়া যেতে পারে, অন্যান্য কার্বোহাইড্রেটের সাথে মিলিয়ে।
২. ডায়াবেটিসে কোন তেল সবচেয়ে ভালো?
সরিষার তেল, সয়াবিন তেল (সীমিত পরিমাণে), রাইস ব্র্যান অয়েল, ক্যানোলা অয়েল এবং জলপাইয়ের তেল (অলিভ অয়েল – বিশেষ করে এক্সট্রা ভার্জিন) ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো পছন্দ। এগুলোতে অসম্পৃক্ত চর্বি বেশি থাকে যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ঘি, মাখন, ডালডা, নারকেল তেল এবং পাম অয়েল এড়িয়ে চলুন বা অত্যন্ত কম ব্যবহার করুন।
৩. রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে দিনে কয়বার খাবার খাওয়া উচিত?
সাধারণত ৩ বার প্রধান খাবার (সকাল, দুপুর, রাত) এবং ২-৩ বার ছোট ছোট স্বাস্থ্যকর নাস্তা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর প্রধান কারণ হলো দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকলে রক্তে শর্করা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) বা পরবর্তীতে বেশি খেয়ে ফেলার ঝুঁকি থাকে। নিয়মিত বিরতিতে খেলে রক্তে শর্করার ওঠানামা কম হয়। তবে এটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। আপনার চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সাথে পরামর্শ করুন।
৪. ডায়াবেটিস রোগীরা কি চা/কফি খেতে পারবেন?
হ্যাঁ, খেতে পারবেন, তবে কিছু শর্তে। কালো চা বা কফি (ব্ল্যাক টি/ব্ল্যাক কফি) বেছে নিন। এতে চিনি বা মিষ্টি যোগ করবেন না। দুধ দিলে লো-ফ্যাট দুধ সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করুন। দিনে ২-৩ কাপের বেশি পান করবেন না। অতিরিক্ত ক্যাফেইন কিছু মানুষের রক্তে শর্করার ওঠানামা বাড়াতে পারে। গ্রিন টি একটি ভালো বিকল্প।
৫. ডায়াবেটিস ডায়েট মেনে চলার পরও শর্করা নিয়ন্ত্রণে না এলে কী করব?
যদি নিয়মিত সঠিক ডায়েট প্ল্যান এবং শারীরিক পরিশ্রমের পরও রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে অবশ্যই দ্রুত আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন। এর কারণ হতে পারে:
- ওষুধের ডোজ বা ধরন পরিবর্তনের প্রয়োজন।
- অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন: থাইরয়েড, সংক্রমণ)।
- মানসিক চাপ।
- ডায়েট প্ল্যানে কোনো ভুল বা অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট খাওয়া।
- ব্যায়ামের অভাব।
চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কারণ নির্ণয় করে সঠিক ব্যবস্থা নেবেন।
৬. গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের (Gestational Diabetes) ডায়েট প্ল্যান কি আলাদা?
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেও মূল নীতিগুলো (পরিমিত কার্বোহাইড্রেট, বেশি আঁশ, লিন প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি, নিয়মিত খাবার) একই থাকে। তবে গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর পুষ্টির চাহিদা ভিন্ন হওয়ায়, কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ ও বণ্টন এবং ক্যালরির মাত্রা আলাদাভাবে নির্ধারিত হয়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান বা পুষ্টিবিদের তত্ত্বাবধানে ব্যক্তিগতকৃত ডায়েট প্ল্যান অনুসরণ করা উচিত।
ডায়াবেটিস কোনো বাকী জীবনের শাস্তি নয়, বরং একটি জীবনবোধের পরিবর্তনের আহ্বান। রেহানা সাহার মতো আপনিও পারেন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়েট প্ল্যান কে জীবনের অংশ বানিয়ে রক্তের শর্করাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে। মনে রাখবেন, প্রতিটি সুস্থ সকাল শুরু হয় গতকালের সঠিক পছন্দের মধ্য দিয়ে। আজই শুরু করুন পরিমিত ও সুষম খাবার গ্রহণ, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা। আপনার প্লেটে সাজানো রঙিন শাকসবজি, এক টুকরো মাছ, লাল চালের অল্প ভাত— এগুলোই হতে পারে আপনার সুস্থ ভবিষ্যতের ভিত্তি। ডায়াবেটিসকে জয় করুন জ্ঞানের অস্ত্রে, জীবনকে উপভোগ করুন পূর্ণ উদ্যমে। আপনার ডায়াবেটিস জার্নিতে সফলতা কামনা করে, আজ এখানেই শেষ করছি। নিয়মিত রক্তের শর্করা পরীক্ষা করুন, চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ রাখুন এবং সুস্থ থাকুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।