অমিতাভ ভট্টশালী, বিবিসি বাংলা (কলকাতা): ভারতে দিল্লি এবং আশপাশের এলাকায় আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ঢাকায় ফেরানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ২৪শে এপ্রিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
এর আগে সোমবার চেন্নাই থেকে ঢাকায় বিশেষ বিমান চালাতে শুরু করেছে একটি বেসরকারি বিমান সংস্থা এবং ইউএস বাংলার একটি বিমানে চেন্নাই থেকে ঢাকা ফিরে গেছেন ১৬৪ জন বাংলাদেশি।
ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মঙ্গলবার জানিয়েছে যে ২৪শে এপ্রিল নাগাদ দিল্লি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ বিমান চালানো হবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ওই বিমানটি পরিচালনা করবে এবং টিকিট ব্যক্তিগতভাবেই কাটতে হবে।
বিমানের ওয়েবসাইটে ওই বিশেষ বিমানের টিকিটের দাম দেখানো হচ্ছে ভারতীয় মুদ্রায় ৩৫,০০০ রুপির বেশি।
একটি ফেসবুক পোস্টে হাইকমিশন জানিয়েছে, বিশেষ বিমানটিতে ওঠার আগে কোভিড মুক্ত – এই সার্টিফিকেটও ভারতীয় কোনও হাসপাতাল থেকে যাত্রীদের যোগাড় করতে হবে আর দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছনোও ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরই করতে হবে – যদিও তার অনুমতি পেতে আবেদন করতে হবে হাইকমিশনের কাছে।
চেন্নাই-ঢাকা হোক বা দিল্লি-ঢাকা, বিশেষ বিমানগুলির ভাড়া অত্যন্ত বেশি, এবং বেশিরভাগের পক্ষেই তা বহন করা প্রায় অসম্ভব বলে জানাচ্ছেন ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের একাংশ। এ নিয়ে তারা দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনের ফেসবুক পাতায় মন্তব্যও করছেন।
তারা বলছেন, এমনিতেই এক মাস যাবৎ লকডাউনে আটকে পড়ে তাদের অর্থসঙ্কট রয়েছে। তারপরে যদি একেকজনের জন্য ৩৫-৪০ হাজার রুপি বিমান ভাড়া দিতে হয়, তা তাদের পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
তামিলনাডুর ভেলোরে মাকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সেখানে আটকে আছেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মুহম্মদ শাখাওয়াত হোসেন।
বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “যে বাজেট নিয়ে এসেছিলাম, তা শেষ। দেশ থেকে যে টাকা আনাবার ব্যবস্থা করব, সেই উপায় নেই। নারায়ণগঞ্জ পুরো লকডাউনের মধ্যে।
“এদিকে লজগুলির ভাড়া মকুব করার নির্দেশ দিয়েছিল তামিলনাডু সরকার। কিন্তু লজ মালিকরা তার বিরোধিতা করে সরকারের কাছে যায়, তারপর আগের নির্দেশ বদল করে অর্ধেক ভাড়া দিতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে। কোথা থেকে টাকা জোগাড় করব, সেই চিন্তায় আছি,” বলছেন মুহম্মদ শাখাওয়াত হোসেন।
“তিন বেলা তামিলনাডু সরকার খাবার দিচ্ছে, তবে ওই খাবারে আমরা অভ্যস্ত নই, তাই খেতে পারছি না। অনেককে দেখছি দুপুরের খাবার কখন দেবে, সেজন্য থালা হাতে রাস্তায় অপেক্ষা করছে। এই পরিস্থিতিতে কোনও মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষেই দুজনের জন্য ৮০ হাজার রুপি বিমান ভাড়া দেওয়া সম্ভব না,” বলছিলেন মি. হোসেন।
ভেলোরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে যেসব বাংলাদেশি আটকে পড়েছেন, তাদের অনেকেই এখন ভাবছেন অত ভাড়া দিয়ে দেশে ফিরে না গিয়ে ভারতেই আরও কিছুদিন থেকে যাওয়া যায় কি না।
বিশেষ বিমানটি যেহেতু চেন্নাই থেকে ঢাকা যাচ্ছে, দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে আটকে থাকা বাংলাদেশিরা দিল্লির হাইকমিশনের ফেসবুক পাতায় সমস্যার কথা জানাচ্ছেন।
আরিফুল ইসলাম চৌধুরী যেমন লিখেছেন, “ব্যাঙ্গালুরু থেকে আটকে পড়া শত শত বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করুন। অথবা ব্যাঙ্গালুরু থেকে সড়কপথে চেন্নাই আসার ব্যবস্থা করুন।”
ওই ফেসবুক কমেন্টের মাধ্যমেই একই শহরে আটকে পড়া অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করছেন।
মি. চৌধুরীর মন্তব্যে মুহম্মদ রাশেদুর রহমান লিখেছেন যে, তিনি অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ব্যাঙ্গালোর থেকে চেন্নাই যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। দুজনেই একসঙ্গে যেতে পারেন ওই উপায়ে, সেই প্রস্তাবও আসছে ফেসবুকেই।
শুধু ভেলোর বা চেন্নাইতে নয়, হায়দ্রাবাদ, মুম্বাই, গুজরাত, পাঞ্জাব এবং রাজধানী দিল্লিতেও বহু বাংলাদেশি নাগরিক আটকে পড়েছেন। তাদের অনেকেও সমস্যার কথা জানিয়ে দিল্লির হাইকমিশনের ফেসবুক পাতায় বা হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে।
হায়দ্রাবাদ থেকে অপর্ণা বণিক বা মুম্বাই থেকে নাসরিন আখতার নিজের নিজের শহর থেকে কীভাবে বাংলাদেশে ফিরতে পারেন, সেই তথ্য জানতে চেয়েছেন ফেসবুকে।
অনেকের সমস্যারই সমাধানও করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমেই। দিল্লি এবং আশপাশের অঞ্চলে যারা আটকে আছেন, তারা কদিন ধরে বারে বারেই জানতে চাইছেন ওইদিকে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকরা কীভাবে ফিরতে পারেন।
মঙ্গলবার হাইকমিশন জানিয়েছেন যে ২৪শে এপ্রিল বিশেষ বিমান যাবে দিল্লি থেকে। তবে সেই বিমানের ভাড়াও ভারতীয় মুদ্রায় ৩৫ হাজার রুপির বেশি। দিল্লিতে আটকে থাকা শেখ মুনির বলছিলেন এত টাকার ব্যবস্থা করা কঠিন।
ব্যবসার কাজে দিল্লিতে গিয়ে তিনি পাহাড়গঞ্জের একটি হোটেলে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন প্রায় একমাস ধরে।
“খুবই শোচনীয় অবস্থা এখানে। এই এলাকা হটস্পট হয়ে গেছে। তাই হোটেলের ঘরের বাইরে বেরতে পারছি না। দোকানপাটও প্রায় কিছুই খোলা নেই। কোনওমতে একবেলা খেয়ে অন্য বেলা উপোষ করে কাটাচ্ছি।
“শুধু আমরা না, এই এলাকার অনেক হোটেলেই দেশের অনেক মানুষ আছেন। সবারই একই অবস্থা। শুনছি হাই-কমিশন অনেকের কাছে খাবার পৌঁছিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু আমার কাছে তো কিছু আসে নি,” জানাচ্ছিলেন মি. মুনির।
তিনিও টিকিটের দাম জেনে বলছেন, “এত টাকা দিয়ে বাংলাদেশে ফেরার টিকিট কী করে কাটব? দেশ থেকে টাকাই বা কীভাবে আনব? এখানে তো সবই লকডাউন।”
তবে যারা স্থল-সীমান্ত বন্দরগুলির কাছাকাছি রয়েছেন, তাদের অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ফেরত যাচ্ছেন।
ভিসা নিয়ে যেসব বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে এসেছিলেন, তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়াতে ছাড় দিয়েছে ভারত সরকার।
দুই দেশের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আর বড় স্থল সীমান্ত বন্দর পেট্রাপোলের কাছেই থাকেন কার্তিক চক্রবর্তী।
তিনি বলছিলেন, “যেহেতু ভিসা নিয়ে এদেশে আসা বাংলাদেশিদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছে ভারত, তাই পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে অনেকেই চলে যাচ্ছেন। খুব সকালের দিকে দেখছি কলকাতা বা অন্য জায়গা থেকে তারা গাড়ি ভাড়া করে আসছেন।
“পুলিশ আটকাচ্ছে হয়তো, কিন্তু বাংলাদেশি পাসপোর্ট-ভারতীয় ভিসা দেখে ছেড়ে দিচ্ছে। লকডাউন শুরুর দিকে সংখ্যাটা বেশি ছিল। কিন্তু গত কদিন ধরে সেটা কমেছে দেখছি,” বলছেন মি. চক্রবর্তী।
ভারতীয় ইমিগ্রেশন পেরিয়ে জিরো লাইনের আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মেডিক্যাল ক্যাম্প বসেছে। সেখানেই সব বাংলাদেশিদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ভারতে লকডাউন শুরু হওয়ার সময়ে প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে অবস্থান করছিলেন – এদের মধ্যে বিভিন্ন ভারতীয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার খানেক ছাত্রও আছেন।
তাদের অনেকেও দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফেসবুক পাতায় নিজেদের সমস্যার কথা লিখছেন। আবার আটকে পড়া বাংলাদেশিদের তথ্য সরবরাহ করার জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও খুলেছে হাইকমিশন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।