নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও গাজীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। গত শুক্রবার সকালে একটি সরকারি পুকুরের দুই পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকান উচ্ছেদের মৌখিক নোটিশকালে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
গাজীপুর মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র জয়দেবপুর-রাজবাড়ী সড়কের দক্ষিণে কচুরীপানা ও ময়লা আবর্জনায় ভরা একটি বিশালাকৃতির সরকারি পুকুর রয়েছে। জেলা প্রশাসক নাফিস আরেফিনের উদ্যোগে শুক্রবার (৮ নভেম্বর) সকালে পুকুরটিতে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করা হয়। পুকুরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলাকালে পুকুরের উত্তর পাশে ও পূর্ব পাশের কোনায় গড়ে ওঠা অবৈধ দোকান এবং দোকান থেকে পুকুরে আবর্জনা ফেলার বিষয়টি দৃষ্টগোচর হয়।
ওই সময়ে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: কায়সার খসরু, গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) অভ্র জোতি বড়াল, গাজীপুর সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুকসানা খাইরুন্নেসা, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোঃ মনির হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের গাজীপুরের সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান, বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল গাজীপুর জেলা শাখা সাধারণ সম্পাদক এম. আসাদুজ্জামান সাদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ঐ পুকুরের পূর্বপারে সদর হাসপাতাল রোডের পশ্চিম পাশে ও পুকুরের উত্তর পারে জয়দেবপুর-রাজবাড়ী সড়কের দক্ষিণ পাশে সরকারী জায়গা দখল করে বেশকিছু অবৈধ দোকানপাট গড়ে ওঠেছে। এসব দোকান বছরের পর বছর পাশের ফুটপাথ দখল করে জনগণের চলাচলে দূর্ভোগ সৃষ্টি করছে এবং ময়লা আবর্জনা পুকুরে ফেলছে। এসব দোকানের সামনের ফুটপাথ দখল করে তাদের পন্যের পসরা সাজিয়ে রাখায় ব্যস্ততম রাজবাড়ী সড়কে পথচারীদের চলাচলেও অসুবিধা সৃষ্টি হয়। ফুটপাথ দখলে থাকায় পথচারীদের মারাত্বক ঝুটি নিয়ে সড়কের উপর দিয়েও চলতে দেখা যায়। সরকারি নথি পত্র অনুযায়ী, এটি সরকারি জায়গা এবং দোকানপাটগুলি অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। এসব দোকান উচ্ছেদে সচেতন মহল দীর্ঘদিন ধরে দাবী জানিয়ে আসছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতারা এসব দখলে জড়িত থাকায় বিগত সময়ে কোন জেলা প্রশাসক এগুলো উচ্ছেদে সাহস পাননি।
পুকুর পরিস্কার কাজ চলাকালীন উপস্থিত জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ ওই দোকানগুলির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে যান। দোকানগুলি সরেজমিনে পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ এ দোকানের ভাড়া কে নেয়, দোকানের মালিক কে এসব জানতে চান।
তখন বেশ কয়েকজন দোকানদার জানান, তারা এই দোকানগুলোতে ভাড়া থাকেন। আর এসব দোকানে ভাড়া নেন স্থানীয় আইবুবুর রহমান ও জামাল উদ্দিন গংরা। আমরা তাদের থেকেই জামানত দিয়ে দোকান নিয়েছি।
এসময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, কয়েক দিনের মধ্যে এ সমস্ত মালামাল যেন তারা সরিয়ে নেন। পুকুর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার পর পুকুরের চারপাশ পরিস্কার রাখা ও নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে পুকুরের চারপাশ অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। এতে আশেপাশের কেউ পুকুরে ময়লা ফেলে পুকুর নষ্ট করতে পারবে না এবং জনসাধারণের চলাচলের জন্য পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এতে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের যেমন উপকার হবে একইভাবে নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। মৌখিকভাবে উচ্ছেদের নোটিশ জানানোর সময় কর্মকর্তাদের সাথে কয়েকজন দোকানদার অথবা দোকানে উপস্থিত কর্মচারীগণ অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন। এছাড়াও এ সময় অনেক দোকানদার দোকান খোলা রেখে পালিয়ে যান। তাদের কর্মচারীরা তখন দোকানে বসা ছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব দোকান থেকে ভাড়া উত্তোলনের বিষয়ে যে দুজনের নাম পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে জামাল উদ্দিন, গাজীপুর ক্রীড়া সংস্থার স্বঘোষিত সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ঘনিষ্ঠজন। তিনি ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের নাম ভাঙ্গিয়ে গাজীপুর মহানগরীর শহীদ বরকত স্টেডিয়ামের বেশ কিছু দোকানপাট ভাড়া দিয়ে সেইসব টাকা উত্তোলন করে থাকেন। আর আজকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে দোকানদাররা জানালো এসব দোকানের ভাড়াও তিনি নিয়ে থাকেন। আরেকজন, আইয়ুবুর রহমান, তিনি গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শক্তিশালী প্রার্থী মাসুদ রানা এরশাদের ভাই। এছাড়া, এরা দুজনই গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অনেক নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী, এমপির মতো উল্লেখিতরাও আত্মগোপনে দেশে অথবা বিদেশে চলে গেছেন। পাঁচ আগস্টের পর থেকে উল্লেখিত দুইজনকেও এলাকায় আর দেখা যাচ্ছে না। তারপরেও, প্রশাসনের নাকের ডগায় তাদের নামে অবৈধ দোকানের ভাড়া উত্তোলন করা হয়, এ বিষয়টি জানার পর অনেকেই বিস্মিত হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায় এছাড়াও শহরের বিভিন্ন পয়েন্টের অন্তত ১০ টি সিএনজি স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি হয় তাদের নামেই।
পুকুরের পাড়ে অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিষয়ে গাজীপুর বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোঃ মনির হোসেন বলেন, পুকুর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের সময় আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অবৈধ দখলদারদের বক্তব্য আমিও শুনেছি। পুকুরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় অবস্থিত। পুকুরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তারপর এর চারপাশের দখল উচ্ছেদ করা হলে এবং সেখানে ওয়াকিং নির্মাণ করা হলে তা স্থানীয় জনসাধারণের অনেক উপকারে আসবে।
ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন গাজীপুর শাখা সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান বলেন, পুকুরে দুই পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা গুলো জনস্বার্থে উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি ও নগরবাসীর চলাচলের সুবিধার জন্য এটি একক সময়ের দাবি। রাজনৈতিক পরিচয় এ যে কোন অন্যায় প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।
এবিষয়ে দৃষ্টিগোচর হলে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল করিম রনি বলেন, আমরা সব সময় বলে আসছি, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার প্রেতাত্মারা এ দেশেই রয়ে গেছে। দেশে এসব নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হচ্ছে কিন্তু তারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না। তিনি গাজীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সকল অবৈধ দখল উচ্ছেদ, চিহ্নিত চাঁদাবাজদের গ্রেফতার করার জন্য প্রশাসনের নিকট দাবি জানান। এ সময় তিনি আরো বলেন, জনস্বার্থে সরকারি জমি অবৈধ দখলদারদের অবশ্যই উচ্ছেদ করা উচিত। আওয়ামী লীগের এসব চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করলে দেশের আইনশৃঙ্খলারও উন্নয়ন হবে এবং জনগণের স্বস্তি ফিরে আসবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।