জেন-জিরাও পিটিএসডিতে আক্রান্ত হতে পারে, আর হচ্ছেও। বিশেষ প্রযুক্তিনির্ভর এই প্রজন্মের মধ্যে দোদুল্যমানতা অনেক বেশি। তবে মানিসক সমস্যার ক্ষেত্রে এরা আবার সামাজিক ট্যাবুটাকেও ভেঙে দিতে পেরেছে। পিটিএসডি বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষের মধ্যে হতে পারে। এবার আলোকপাত করতে চাই জেন-জিদের পিটিএসডি সমস্যা নিয়ে।
জেন-জিরা প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম। নানা ধরনের গ্যাজেটস, ভার্চ্যুয়াল সম্পর্ক তৈরি করা, একাকিত্ব, সামাজিক মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যয় ভুগছেন এবং তাঁরা সেটা স্বীকারও করছেন। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য চেয়ে এগিয়ে আসছেন। তাঁরা ভেঙে দিয়েছেন সেই টেব্যু যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো সমস্যা হলে তা লুকিয়ে রাখতে হবে বা মানসিক সমস্যা মানেই পাগল।
পিটিএসডি একটি মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা সাধারণত জীবনের কোনো একটি ভয়ংকর ঘটনার কারণে ঘটে। এ সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্মৃতি, অনুভূতি ও আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এটি সাধারণত যুদ্ধ, যৌন নির্যাতনের শিকার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা গুরুতর দুর্ঘটনার পর দেখা দেয়। জেন-জিদের ওপর গবেষণা করে আমেরিকান মেন্টাল হেলথ অ্যাসোসিয়েশান।
২০২২ সালে এ সংস্থার প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সী জেন-জি প্রজন্মের ৪২ শতাংশ মানসিকভাবে অসুস্থ। তাঁদের দিন কাটে অবসাদগ্রস্ততায়। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ পিটিএসডির শিকার হয়েছেন কোভিডের পর থেকে। জেন-জিরা হারিয়েছেন তাঁদের নানা-নানি, দাদা-দাদি, এমনকি মা–বাবাসহ অনেক প্রিয়জন। পরিবারতন্ত্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে।
প্রায় দুই বছর মৃত্যু–আতঙ্ক নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে হয়ে পড়েছেন পিটিএসডির শিকার। পিটিএসডিতে আক্রান্তদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কোনো কিছু করার স্পৃহা হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা মানসিক অবসাদে ভোগেন, শারীরিকভাবে কোনো কিছু করারও শক্তি পান না। তাঁদের মনে হয়, তাঁদের জীবনে কোনো আশা নেই। তাঁদের কাছে সবকিছুই দুরূহ ঠেকে। অনেকেই আত্মহননের কথা ভাবে বা জীবনকে শেষ করে দিতে চায়।
পিটিএসডির একটি বড় কারণ হলো নিয়ন্ত্রনহীনতা। জীবনের এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া, যখন নিজের জীবনের ওপর নিজের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণই থাকে না।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমাগত তুলনা, সাইবার বুলিং, অনলাইন হুমকির কারণে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া, প্রযুক্তির কারণে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধ, মহামারির মতো বড় ঘটনা থেকে কালেকটিভ ট্রমার কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তাও পিটিএসডি সৃষ্টি করতে পারে। জেন-জিদের পিটিএসডি–সংক্রান্ত মানসিক সমস্যার একটি বড় কারণ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ট্রমা। অতএব এই কালেকটিভ ট্রমাই এ ক্ষেত্রে একটা বড় অনুঘটক।
একটি গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা সমাজ কোনো বড় ধরনের ট্রমাটিক ঘটনার সম্মুখীন হলে সেটা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে, এটাই বস্তুত কালেকটিভ ট্রমা। কিছুদিন আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পুরো বাংলাদেশের মানুষ তো বটেই, বিদেশিরাও বিভিন্নভাবে কালেকটিভ ট্রমার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এমন বিদেশিদের অনেকেই আমার কাছে কাউন্সেলিংয়ের জন্য এসেছেন। অথচ তাঁরা কখনো বাংলাদেশে যাননি কিংবা তাঁদের কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের ক্ষতি হয়নি। যদিও তাঁরা কালেকটিভ ট্রমার শিকার হয়েছেন ভিডিও দেখে।
পিটিএসডির কারণে মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা, হিপোকিম্পাস, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে প্রভাব পড়ে। হিপোকিম্পাস সংকুচিত হতে পারে, যা স্মৃতি ও মানসিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে। ফলে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। পিটিএসডির কারণে অ্যামিগডালা অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যা উদ্বেগ ও আতঙ্কজনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর কার্যকারিতা হ্রাস পেলে আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয় এবং ইমপালসিভ আচরণ দেখা দিতে পারে। এতে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। সেরোটোনিন ও ডোপামিনের মাত্রা পরিবর্তিত হলে বিষণ্নতা ও অন্যান্য মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে।
সেরোটোনিন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার, যা মস্তিষ্কে মেজাজ, ঘুম আর ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। পিটিএসডির কারণে সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায়। এতে বিষণ্নতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। সেরোটোনিনের অভাবের ফলে মেজাজের স্থিতিশীলতাও কমে যায় এবং ব্যক্তি হতাশা অনুভব করা শুরু করে।
পিটিএসডির প্রভাবে ডোপামিনের উৎপাদন কমে যায়, যা মোটিভেশন ও আনন্দের অনুভূতিকে কমিয়ে দেয়। ডোপামিনের ভারসাম্যহীনতা বিষণ্নতা ও উদাসীনতার পাশাপাশি ইমপালসিভ আচরণের কারণ হতে পারে। পিটিএসডি দীর্ঘমেয়াদি হলে মস্তিষ্কে কর্টিসল এবং অন্যান্য স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
কর্টিসলের অতিরিক্ত নিঃসরণ হয়, যা সেরোটোনিন ও ডোপামিনের কার্যকারিতা হ্রাস করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া পিটিএসডি মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটিকেও প্রভাবিত করে, যা নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর কার্যকারিতা ও আন্তসংযোগে প্রভাব ফেলে। ফলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সংবেদনশীলতা বাড়ে, যা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়াতে থাকে।
পিটিএসডিতে আক্রান্ত জেন-জি প্রজন্ম এসব কারণে প্রায়ই অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। তাই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের প্রতিক্রিয়া খুব তীব্র হতে পারে এবং হয়েও থাকে। এতে তাদের পারিবারিক, দাম্পত্য, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে।
পিটিএসডি থেকে বের হয়ে আসতে হলে দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি আর কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয়। আমি আমার ট্রিটমেন্ট প্ল্যানে খাবার, পুষ্টি, হারবাল, সাউন্ড থেরাপি, ইনার প্রোগ্রামিংয়ে বদল ইত্যাদির সংমিশ্রণে তাদের সাহায্য করে থাকি। কোনো জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষ একটি কঠিন পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিনের পর দিন গেলে সেই সমাজ ও পরিবারের সবাই কমবেশি ট্রমাটাইজড হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।