পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা পিটিএসডি সমস্যায় বড়রা আক্রান্ত হয়ে থাকে বলেই আমাদের গড়পড়তা ধারণা। অথচ ছোটরাও যে এর শিকার হতে পারে, সেটা আমরা আমলে নিই না। বর্তমানে আলফা জেনারশনও ভয়াবহ শিকার হচ্ছে পিটিএসডির।
আপনাদের অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্য। অনেকেই অনুরোধ করেছেন শিশুদের পিটিএসডি নিয়ে লেখার। জেনারেশন আলফা কি এত তাড়াতাড়ি পিটিএসডিতে আক্রান্ত কি না, এ বিষয়েও জানতে চেয়েছেন অনেকে। অনেক মা–বাবা এত কিছু দেওয়ার পরও তাঁদের সন্তানেরা কেন বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছে, সেই কারণ তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। আপনাদের জন্যই আজকের এই লেখা।
আমি গত তিন বছরে অনেক শিশু রোগী পাচ্ছি, যাদের বয়স ৮ থেকে ১০–এর ভেতর এবং যারা পিটিএসডিতে আক্রান্ত। একটি শিশু স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সে সারা দিন ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখে কী কী উপায়ে মানুষ আত্মহত্যা করে। তার সঙ্গে কথা বলার পর সে স্বীকার করেছে যে ২০২০-এর লকডাউনের সময় তাকে বাসায় একা থাকতে হয়েছে কেবল কাজের মেয়ের সঙ্গে।
তার মা–বাবা দুজনই ডাক্তার। ফলে সরকারি নিয়মানুযায়ী তাঁরা একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাসায় আসতে পারেননি। সে সময় শিশুটি দিনরাত ভয়ে থাকত। সেই ভয় তাকে এখনো তাড়া করে। তার কিছু করতে ভালো লাগে না, স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। তার কোনো বন্ধু নেই।
শিশুটির ধারণা তার ক্লাসের অন্য শিশুরাও তার মতোই বিষণ্নতায় ভোগে। তারা সবাই নিজেদের বলয়ে থাকতে পছন্দ করে বা ভিডিও গেমস নিয়ে কথা বলে বা তাকে এবং অন্য শিশুদের হেয় করে কথা বলে বা বুলি করে। শিশুটি একাকিত্বের কঠিন ছোবলে আক্রান্ত। সে তার মা–বাবাকে আপসেট করতে চায় না এবং তাদের সঙ্গে কিছু শেয়ার করে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে একদিন নিজেকে মেরে ফেলবে। তার মা তাকে আমার কাছে আনার পর আমি তার ছয়টি সেশন নিই। এর মধ্যে শিশুটি সুস্থ হয়ে যায় এবং সেশন চলাকালে সে স্কুলে ফিরে যায়।
আরেকটি শিশু এসেছিল, যে কিনা নিজেই এআই ক্যারেকটার বানিয়েছিল কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করে। সেও একমাত্র সন্তান। বেশ কয়েক মাস পর সে তার কল্পনার বন্ধুদের বাস্তবে পেতে চাইতে শুরু করে। খুবই স্মার্ট শিশু। সে জানত যে এটা কখনো সম্ভব নয়। সে আবার সবকিছু ডিলিট করেও দিয়েছিল। এর পর থেকেই শুরু হয় ডিপ্রেশন।
সে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিতে লাগল। এসব শিশুর এআই ক্যারেক্টারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কারণে তাদের মধ্যে বাস্তব মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরিতে অভাব দেখা দিচ্ছে। এ কারণে তারা সঠিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে না। দীর্ঘ মেয়াদে, এটি তাদের সামাজিক দক্ষতা এবং আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুর এআই চরিত্রের সঙ্গে সংযোগ বেশি, তারা বাস্তব জীবনে বন্ধুত্ব স্থাপনে অক্ষম হয়, যা একাকিত্ব ও অবসাদ সৃষ্টি করছে। ডিজিটাল যুগে শিশুদের জন্য এআই ক্যারেক্টাররা (যেমন ভার্চ্যুয়াল আসল বন্ধু, গেমের চরিত্র অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার ডিজিটাল ব্যক্তিত্ব) একটি বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। এসব এআই ক্যারেক্টার তাদের সঙ্গে কথা বলে, খেলা করে ও বিনোদন দেয়। এ সময়ে বাস্তব জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য শিশুদের নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আগেও লিখেছি, আজকেও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আলফা জেনারেশনের সঙ্গে। আলফা হলো সেই জেনারেশন, যারা ২০১০ সাল থেকে জন্মগ্রহণ করছে। এই প্রজন্ম আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে বড় হচ্ছে এবং ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডিজিটাল টেকনোলজির পাশাপাশি, এই প্রজন্ম আন্তর্জাতিক ইভেন্ট ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় একটি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে।
এসব শিশু ভার্চ্যুয়াল আর বাস্তবতার মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। মস্তিষ্কের অ্যান্টিরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্স অংশটি আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে। এআই ক্যারেক্টারদের মধ্যে আবেগের অভাব এবং পূর্বনির্ধারিত আচরণের কারণে এবং শিশুরা যা শুনতে ও করতে পছন্দ করে, তা বারবার রিপিট করে শোনানোর ও দেখানোর কারণে শিশুরা প্রকৃত আবেগ, কোনো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে পড়লে এআই থেকে বা ভিডিও গেম থেকে বা ইন্টারনেট থেকে যা শিখেছে, তার বাইরের কোনো কিছু মেনে নিতে হিমশিম খায়।
মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা সংকট ও ভয়াবহতা শনাক্তকরণে শিশুকে সাহায্য করে। কোনো শিশু যখন ভিডিও গেম বা বিভিন্ন ধরনের অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে যায়, তখন ভার্চ্যুয়াল চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, তখন তারা সেই গেমের স্কোর বাড়ানো বা কীভাবে জিততে পারবে বা যুদ্ধের ভিডিও দেখে কীভাবে শত্রু পক্ষকে হারাতে পারবে, তা নিয়েই ভাবতে থাকে। অনেক শিশুই বাস্তব আর ভার্চ্যুয়ালিটির মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে।
অনেকেই বাস্তব জীবনের বন্ধুদের বন্ধু না ভেবে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। এতে করে বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। এর পর থেকে শিশুরা গভীর ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করে। বাস্তব জীবনের বিপরীত আবেগগুলো তাদের উদ্বেগ, ভয় ও চাপের প্রতিক্রিয়া বোঝার প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
আলফা জেনারেশনের অনেক শিশুই আসল বাস্তবতা মোকাবিলা করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এই পরিবর্তন তাদের আবেগ চিহ্নিতকরণ এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে হ্রাস করে দিচ্ছে। এতে করে তারা খুব অল্প বয়সেই পিটিএসডিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
আলফা জেনারেশন খুবই সম্ভাবনাময় একটি প্রজন্ম। এসব শিশুকে বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল জগতের মধ্যে পার্থক্য বোঝানোর জন্য মা-বাবা এবং পরিবারের লোকদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
শিশুদের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় দিয়ে সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাদের বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সাহায্য করতে হবে। তাদের নিজেদের ভালোবাসার পাশাপাশি অন্যদেরও ভালোবাসতে শেখাতে হবে। তাদের সামনে নিজেদের নিয়ে বিশ্রী রকমের ঝগড়া করা বন্ধ করতে হবে। আর যেসব শিশু পিটিএসডিতে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তাদের থেরাপিস্ট ও মনোজগৎ নিয়ে কাজ করতে পারে এবং জেনারেশন আলফাকে বুঝতে পারে—এমন বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।