বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের জন্য একটি বড় খবর। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও চিকিৎসকদের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক অবশেষে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার মুখ দেখেছে। ২০২৫ সালের ৫ মে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন এমন এক প্রস্তাব দিয়েছে যা ওষুধ কোম্পানির বিপণন কৌশলে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও চিকিৎসকদের সম্পর্ক: নতুন নীতিমালা ও প্রভাব
এই সুপারিশ অনুযায়ী, এখন থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো আর চিকিৎসকদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পারবে না। অর্থাৎ, কোম্পানির প্রতিনিধি বা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে ওষুধের প্রচার চালাতে পারবেন না। এখন শুধুমাত্র ডাক কিংবা ই-মেইলের মাধ্যমে তথ্য পাঠানো যাবে। এটি চিকিৎসকদের পেশাগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ও রোগীদের স্বার্থ রক্ষা করতে সহায়ক হবে।
ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, “ওষুধের নমুনা বা উপহার দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।” এটা এমন এক উদ্যোগ যা চিকিৎসকদের কেবলমাত্র রোগীর সুস্থতাকে কেন্দ্র করে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
এই নতুন নীতিমালার ফলে প্রতিযোগিতামূলক প্রোডাক্ট প্রোমোশন কৌশল একধরনের নৈতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করবে। একই সঙ্গে, রোগীদের জন্য নিরপেক্ষ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হবে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যেটি বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে।
প্রতিবেদনের অন্যান্য সুপারিশ: ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবার নতুন রূপরেখা
এই সংস্কার প্রস্তাবে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ রয়েছে:
- অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সংখ্যা বাড়ানো এবং প্রতি দুই বছর অন্তর তা আপডেট করা।
- প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে এবং পরবর্তীতে ভর্তুকিমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত।
- ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের ওষুধে ভ্যাট ও কর মওকুফ করার প্রস্তাব।
- অতিদরিদ্র ২০% জনগণকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পরিকল্পনা।
- বেসরকারি হাসপাতালে ১০% দরিদ্র রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
এই সুপারিশগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের কাঠামোকে আধুনিক, সংবেদনশীল এবং রোগীকেন্দ্রিক করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। একদিকে যেমন সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটে জিডিপির ৫% ও মোট বাজেটের ১৫% বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলকে আধুনিকায়নের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফল
কমিশনের সুপারিশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করার প্রস্তাব এসেছে, যা বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। পাশাপাশি, চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন নীতিতে বিশাল পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। এখন থেকে প্রেসক্রিপশনের অন্তত ২৫% ওষুধ জেনেরিক নামে লিখতে হবে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে তা ১০০% করতে হবে।
এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে, ওষুধের দাম কমবে, রোগীরা বিকল্প খুঁজে পাবে এবং একই সঙ্গে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির উপর নির্ভরতা কমে আসবে।
কমিশনের গঠন ও সদস্যরা
এই কমিশন গঠন করা হয় ২০২৪ সালের নভেম্বরে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন:
- প্রফেসর ডা. লিয়াকত আলী (পথিকৃৎ ফাউন্ডেশন)
- অধ্যাপক ডা. নাইলা জামান খান (শিশু নিউরো বিশেষজ্ঞ)
- অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক (গ্রিন লাইফ রিউম্যাটিক কেয়ার)
- ডা. আহমেদ আহসানুর রহমান (আইসিডিডিআরবি বিজ্ঞানী)
- ডা. মুজাহেরুল হক (WHO এর সাবেক উপদেষ্টা)
এই বহুমুখী পেশাদারদের নিয়ে গঠিত কমিশন স্বাস্থ্যখাতের গভীর সংস্কারে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী।
ইতালির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম বৈধ অভিবাসন চুক্তি: অভিবাসীদের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার
স্বাস্থ্যখাতে স্বচ্ছতা ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ভূমিকা
স্বাস্থ্যখাতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর অবদান অস্বীকার করা যায় না। তবে, রোগীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত চিকিৎসা জরুরি। কমিশনের এই সুপারিশগুলো তা বাস্তবায়নের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিদের জন্য এটি আত্মসমালোচনার এক সুবর্ণ সময়, যেখানে প্রোডাক্ট প্রোমোশনের বদলে গবেষণা, উদ্ভাবন এবং রোগীর কল্যাণকে সামনে আনা জরুরি।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
অভ্যন্তরীণভাবে, এই পরিবর্তনগুলো নীতিনির্ধারক, চিকিৎসক, গবেষক এবং স্বাস্থ্যসেবার খবর খোঁজার পাঠকদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও তাদের প্রতিনিধি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে নৈতিক চিকিৎসা চর্চার পথ আরও প্রশস্ত করবে।
FAQs
- চিকিৎসকদের সঙ্গে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রতিনিধিরা কেন দেখা করতে পারবেন না?
চিকিৎসকদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ও রোগীর স্বার্থ রক্ষা করতেই এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। - এখন কীভাবে তথ্য পাঠাবে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো?
তারা ডাক বা ই-মেইলের মাধ্যমে চিকিৎসকদের কাছে ওষুধ সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবে। - এই সিদ্ধান্তে রোগীরা কীভাবে উপকৃত হবেন?
রোগীরা নিরপেক্ষভাবে নির্ধারিত ওষুধ গ্রহণের সুযোগ পাবেন, যা চিকিৎসার মান উন্নত করবে। - সকল ওষুধ কি জেনেরিক নামে প্রেসক্রাইব করা হবে?
প্রাথমিকভাবে ২৫% জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন দেওয়া বাধ্যতামূলক, যা ৫ বছরের মধ্যে ১০০% হবে। - এই পরিবর্তন কাদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হবে?
অতিদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা বিনামূল্যে বা ভর্তুকিমূল্যে সেবা পাবে।
Get the latest Zoom Bangla News first — Follow us on Google News, Twitter, Facebook, Telegram and subscribe to our YouTube channel.