আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২০১৯ সালের শরতের আগে করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বে প্রকৃতপক্ষে কোনো বিজ্ঞানীই গবেষণা করছিলেন না। কারণ, এমন রোগের অস্তিত্ব সম্পর্কেও কেউ জানতেন না। সার্ক-কোভ-২ নামের অভিহিত করোনা ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করেছে। তখন থেকেই এটি শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। এর কোনো নামও দেয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু এ বছরের মার্চের শেষ নাগাদ এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের কমপক্ষে ১৭০টি দেশে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ মানুষ। ফলে বিষয়টি আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে বড় এক ইস্যু হয়ে ওঠে।
হাজার হাজার গবেষক তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা বাদ দিলেন। পক্ষান্তরে কাজ শুরু করলেন করোনা মহামারি নিয়ে। পরের মাসগুলো বিজ্ঞান হয়ে ওঠে পুরোপুরি কোভিডময়। যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন দ্য আটলান্টিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোভিড-সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান গবেষণার কমপক্ষে ৭৪ হাজার গবেষণাপত্র তালিকাভুক্ত করেছে বায়োমেডিকেল ভিত্তিক লাইব্রেরি পাবমেড। পোলিও, হাম, কলেরা, ডেঙ্গু অথবা অন্য রোগ নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণাপত্র রয়েছে এই সংখ্যা তার দ্বিগুনেরও বেশি। পোলিও, হাম, কলেরা, ডেঙ্গুর মতো রোগগুলো মানব জাতিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদ্যমান। ১৯৭৬ সালে প্রথম আবিষ্কার হয় ইবোলা। তারপর থেকে ইবোলা-সংশ্লিষ্ট ৯৮০০ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেপ্টেম্বর নাগাদ অভিজাত নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন (এনইজেএম)-এ জমা পড়েছে কোভিড নিয়ে ৩০ হাজার গবেষণা। ২০১৯ সালের মোট সংখ্যার চেয়ে এই সংখ্যা ১৬ হাজার বেশি। এনইজেএম-এর প্রধান সম্পাদক এরিক রুবিন বলেছেন, এটাই হলো কোভিড-১৯ এর পার্থক্য। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের পরিচালক ফ্রাঁসিস কলিন্স বলেছেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এইভাবে অনাকাঙ্খিতভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অগ্রাধিকার পেয়েছে।
ম্যানহাটান প্রজেক্ট এবং অ্যাপোলো কর্মসূটির মতো বিখ্যাত সব উদ্যোগের মতোই এই মহামারি বিশ্বের বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞানীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তারা তাদের শক্তি ব্যবহার করতে থাকেন এর পিছনে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া দেখা দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে। এ ছাড়া যুদ্ধের পরের বছরগুলোতে বৃদ্ধি পায় পোলিও। এসবই বিজ্ঞানীদের মধ্যে তৎপরতা বৃদ্ধি করে। সম্প্রতি ইবোলা এবং জিকা ভাইরাসের মহামারি দেখা দেয়। এর ফলে অস্থায়ী সময়ের জন্য অর্থায়ন এবং প্রকাশনার গতি বৃদ্ধি পায়। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির মাধুকর পাই বলেন, তবে বর্তমানে যা ঘটছে ইতিহাসে এর মাত্রার সমান কখনো ঘটেনি।
এর কারণ অংশত অধিক সংখ্যক বিজ্ঞানী। ১৯৬০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বায়োলজিক্যাল অথবা মেডিকেল গবেষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে সাতগুন। ১৯৬০ সালে এদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা কমপক্ষে দুই লাখ ২০ হাজার। কিন্তু এক শতকের মধ্যে নতুন যেকোনো ভাইরাসের চেয়ে অতি দ্রুত গতিতে এবং বহুদেশে বিস্তার ঘটেছে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের। পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের জন্য এটা ইবোলার মতো হুমকির চেয়েও বেশি। এতে ফুসফুসে প্রদাহ দেখা দেয়। এর ফলে তারা তাদের গবেষণার বা ল্যাব বন্ধ করে দেন। মাধুকর পাই বলেন, এই ভাইরাসটি আমাদেরকে ঘরের মধ্যেও আক্রমণ করছে।
হার্ভার্ডের কিলি মায়ার্স এবং তার টিম যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের ২৫০০ গবেষকের ওপর জরিপ চালান। তাতে তারা দেখতে পেয়েছেন, এসব গবেষকের মধ্যে শতকরা ৩২ ভাগ মনোনিবেশ করেছেন করোনা মহামারির দিকে। নিউরো সায়েন্টিস্টরা গবেষণা করেন ঘ্রাণেন্দ্রিয় নিয়ে। কোভিড বা করোনা আক্রান্ত রোগীরা কেন মৃত্যুমুখে পতিত হন, তারা তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করলেন। যেসব পদার্থবিদ এর আগে যে রোগ তাদেরকে শুধু আক্রান্ত করতো, দেখা গেল তারাও পলিসি নির্মাতাদের কাছে মডেল উপস্থাপন করছেন। ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার মাইকেল ডি এল জনসন সাধারণত গবেষণা করেন ব্যাকটেরিয়ার ওপর কপারের বিষক্রিয়ার প্রভাব নিয়ে। কিন্তু তিনি যখন জানতে পারলেন যে, অন্য ধাতব পদার্থের চেয়ে কম সময় কপার তলের ওপর অবস্থান করতে পারে সার্স-কোভ-২ বা করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস ধাতব পদার্থের ওপর কিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে তিনি তা নিয়ে কাজ শুরু করলেন। অন্য কোন রোগ নিয়ে এতটা মনোযোগ আকর্ষণ করেনি অথবা এতটা বুদ্ধিবৃত্তিক সমন্বয় ঘটেনি এত অল্প সময়ের মধ্যে।
এসব প্রচেষ্টার ফল মিলেছে এরই মধ্যে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই ভাইরাসকে শনাক্ত করার ডায়াগনস্টিক নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি বেরিয়েছে। রেকর্ডভঙ্গকারী গতিতে তৈরি হতে থাকে করোনা ভাইরাসের টিকা। এই ভাইরাসের ভিতর যে গোপনীয় বিষয় আছে, তা আমাদেরকে আরো ভাইরাস সম্পর্কে গভীরে গিয়ে বুঝতে সাহায্য করবে। এর ফলে বিশ্ব পরবর্তী একটি নতুন মহামারি সম্পর্কে ভালভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবে। তবে ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা এই মহামারি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে, নীতি গ্রহণকে প্রভাবিত করেছে। ক্লিনিকগুলো তাদের পরীক্ষায় লাখ লাখ ডলার খরচ করেছে। বর্ণবাদী এবং লিঙ্গগত অসমতা বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে।
এখন পশ্চিমা বিশ্ব এক দীর্ঘস্থায়ী শীতের মধ্যে। ফলে তৃতীয় দফায় করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে সেখানে রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করা যাবে না। কিন্তু মানুষ এখন থেকে কয়েক দশক পরে যখন এই সময়টার দিকে ফিরে তাকাবে তখন তারা নানা কাহিনী বলবে। কিছু তার ভাল। কিছু মন্দ। তারা কথা বলবে বিজ্ঞানের অসাধারণ এই সময়টাকে নিয়ে।
জিন-ইডিটিং টুল বলে পরিচিত সিআরআইএসপিআর নিয়ে এখনও কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের একজন জেনিফার দৌদনা। তিনি এই টুলসের সহ-আবিষ্কারক। এ জন্য তিনি অক্টোবরে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে তিনি তার গবেষণার দিকে ছিলেন নিবিষ্ট। কিন্তু তার ছেলের হাইস্কুল বন্ধ হয়ে গেল, ইউসি বার্কলে- তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেল- করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার জন্য। জেনিফার বলেন, তিন সপ্তাহের মধ্যে আমি এটা ভাবতে বাধ্য হলাম যে, আমাদের পুরো জীবনধারা পাল্টে যাচ্ছে। তিনি ও তার টিম কাজ করেন ইনোভেটিভ জিনোমিকস ইনস্টিটিউটে। ১৩ই মার্চ তিনি ও তার কয়েক ডজন সহকর্মী, একমত হলেন যে, তাদের চলমান প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই আপাতত স্থগিত অবস্থায় রাখতে হবে এবং তাদের দক্ষতা ব্যবহার করতে হচ্ছে কোভিড-১৯ এর দিকে। সিআরআইএসপিআর-ভিত্তিক ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করছিলেন তারা। কিন্তু এতে ঘাটতি থাকায়, তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের করোনা পরীক্ষার জন্য তাদের এই স্থাপনাটিকে একটি পরীক্ষাকেন্দ্র করে তুললেন। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি, কি ঘটছে আসলে।
অন্য বিজ্ঞানীরাও, যারা অন্যসব রোগ নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তারাও দ্রুত ফিরে এলেন একই গবেষণায়। ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেছেন জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একজন প্রফেসর লরা গার্ডনার। তিনি জানতেন, নতুন মহামারিতে মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। তাই তিনি ও তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন মিলে অনলাইনে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যার হিসাব রাখার জন্য একটি ড্যাশবোর্ড সৃষ্টি করলেন। এক রাতের কাজ শেষে তারা এর ফল পেলেন ২২ শে জানুয়ারি। তারপর থেকে ওই ড্যাশবোর্ডের সুবিধা নিচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এজেন্সি, সংবাদ ভিত্তিক সংগঠন এবং উদ্বিগ্ন নাগরিকরা।
ভয়াবহ ভাইরাস বা প্রাণঘাতী ভাইরাস নিয়ে গবেষণা সময়ের একটি উত্তম চ্যালেঞ্জ। গত বছরটিও যেন বিশেষ করে তেমন ছিল। এ েিয় গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদেরকে ল্যাবরেটরিতে ‘তৃতীয় মাত্রার বায়োসেফটি’ ব্যবহার করতে হয়েছে। এর অধীনে পোশাকের ভিতর থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বা প্রবেশ করার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া আছে কিছু কঠোর ব্যবস্থা। প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এমন গবেষণাকেন্দ্র আছে কমপক্ষে ২০০। বিজ্ঞানীরা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করার আগে বেশির ভাগ ওষুধ বা টিকা ব্যবহার করেন বানরের ওপরে। কিন্তু চীন পশু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে বানরের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে করোনার পরীক্ষা এবং অন্যান্য বায়োমেডিক্যাল গবেষণা বর্তমানে অধিক জটিল হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া এক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। ইয়েলের ইমিউনোলজিস্ট আকিকো আইওয়াসাকি বলেছেন, গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে নিজেরাই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
মার্চের দিকে এসে করোনা ভাইরাসকে দ্রুত বিদায় জানানোর সুযোগ যেন উন্মুক্ত হতে লাগলো। আশাবাদ ব্যক্ত করা হলো যে, একটি টিকা এই ভাইরাসকে খতম করতে পারে। কিন্তু একটি টিকা তৈরিতে সাধারণত অনেক বছর লেগে যা। কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে ৫৪টি ভিন্ন টিকা চলে এলো। সেগুলোর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা শুরু হলো। এর মধ্যে ১২টি টিকার ক্লিনিক্যাল তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়। এটাই পরীক্ষার শেষ ধাপ। ফাইজার/বায়োএনটেক এবং মডার্না ঘোষণা করেছে যে, তাদের টিকা শতকরা ৯৫ ভাগ কার্যকর। এ বিষয়ে হোয়াইট হাউজের করোনা ভাইরাস বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এলার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের পরিচালক ড. অ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন, আমরা করোনা ভাইরাসের সিকুয়েন্স জানতে পেরেছি মাত্র জানুয়ারিতে। এখন শরতকাল। এরই মধ্যে আমরা তাকে শেষ করে দেয়ার পর্যায়ে রয়েছি। পরীক্ষা চলছে তৃতীয় পর্যায়ের।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।