জুমবাংলা ডেস্ক : গুমখানায় শীতের সময় এক টুকরা কম্বলও দিত না। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাত পার করেছি। ১৭৪ দিন ধরে নির্মম নির্যাতনের পর একদিন র্যাব সদস্যরা গাড়িতে তুলে বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারের দিকে নিয়ে যায়। আমার দেশ এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ইমাম মেহেদী হাসান ডলার গুমের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, র্যাব ও ভারতীয় স্পেশাল টাস্কফোর্স আমাকে গুম করেছিল।
দেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা আমার দেশ এর ময়মনসিংহয়ের প্রতিনিধি আব্দুল কাইয়ুম-এর আজকের প্রতিবেদনে এমনি তথ্য উঠে এসেছে।
ইমাম মেহেদী হাসান বলেন, শেখ হাসিনার জঙ্গি নাটক তৈরিতে র্যাব আমাকে টার্গেট করেছিল। কারণ, আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি ও সততার সঙ্গে চলি। শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জঙ্গি নাটক তৈরি করে নিজেকে চিরদিনের জন্য ক্ষমতায় রাখতে চেয়েছিলেন। অবশেষে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারের বিদায় হয়েছে। সত্য বলতে, সেই দিনগুলো আমার জীবন থেকে শুধু সময় নয় মানবিকতার অনেকটা অংশও কেড়ে নিয়েছে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার জোড়াবাড়িয়া গ্রামের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ইমাম মেহেদী হাসান ডলার। বিবিএ শেষ করে বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মেহেদী ফিশারি, ইটভাটা ও ঠিকাদারি ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
যেভাবে তুলে নিয়ে গেল
২০২১ সালের ৬ নভেম্বর, আসরের নামাজের পর ফিশারি থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছনকান্দা রোডের বটতলা এলাকায় ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। সেদিন, সাদাপোশাকধারী তিনজন ব্যক্তি, যারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে মেহেদীকে জোরপূর্বক একটি প্রাইভেটকারে তুলে নেয়। মেহেদী এখনো সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা মনে করে শিউরে ওঠেন।
মেহেদী বলেন, ‘গাড়িতে তুলে প্রথমেই আমার হাত আর চোখ শক্ত করে বেঁধে ফেলে। প্রায় তিন-চার ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ছোট্ট, স্যাঁতসেঁতে ঘরে, যা বাথরুমের চেয়েও একটু বড়। সেখানেই আমাকে দিনের পর দিন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আটকে রাখল। শুধু খাবার খেতে বা বাথরুমে যেতে চাইলেই হাত খুলত, তাও অল্প সময়ের জন্য। নামাজ পড়তে চাইলেও তারা হাত আর চোখ বাঁধা অবস্থায় থাকতে বাধ্য করত। এমনকি ঠিকমতো অজু করার সুযোগও দিত না।’
চলে অমানসিক নির্যাতন
আমাকে প্রতিদিন শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করত। আমার চারপাশে আরও ৮-৯ জন বন্দি ছিল। ইশারায় কথা বলে বুঝতে পারি, এটা র্যাব ১ হেডকোয়ার্টার। এই গুমভবনে আমাদের দিনগুলো ছিল যন্ত্রণার অসহনীয় অধ্যায়। মাঝে মাঝে তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অন্যত্র নিয়ে যেত। সেখানে ভয় দেখাত, নির্যাতন করত। নিজেকে যেন জঙ্গি স্বীকার করি সেজন্য চাপ প্রয়োগ করত।
মেহেদী বলেন, ‘গুমখানায় আমাকে ঠিকমতো ঘুমাতে দিত না। শীতের সময় এক টুকরা কম্বলও দিত না। ঠান্ডায় আমি কাঁপতে কাঁপতে রাত পার করেছি। প্রস্রাব-পায়খানা করতে দিত না, গোসলের সময় থাকত মাত্র পাঁচ মিনিট। শরীর আর মন দুটোই যেন তারা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। এমনকি যদি চোখের কাপড় বা হাতকড়া একটু ঢিলা দেখত, তখনই শুরু হতো শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহ রূপ। প্রতিটি মুহূর্ত যেন ছিল নরক যন্ত্রণার মতো।’
ভারতে নিয়ে গেল
মেহেদী হাসানের জীবনের করুণ অধ্যায়ের শেষ নেই। তার নিজের মুখে শোনা প্রতিটি কথা যেন একটি অন্ধকার অধ্যায়ের পাতা উল্টানোর মতো। তিনি বলেন, ‘১৭৪ দিন ধরে আমার ওপর চলতে থাকা এই নির্মম নির্যাতনের পর একদিন র্যাবের সদস্যরা আমাকে গাড়িতে তুলে বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারের দিকে নিয়ে যায়। গন্তব্যে পৌঁছে আমাকে কিছুটা রাস্তা হাটিয়ে তারা ভারতের পশ্চিতবঙ্গের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ) সদস্যদের হাতে তুলে দেয়। তখন আমি সম্পূর্ণ অসহায়, বুঝতেই পারছিলাম না আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে।’
যেভাবে ছাড়া পেলেন
তিনি ভারী কণ্ঠে বলেন, ‘এসটিএফ সদস্যরা আমাকে বর্ডার থেকে নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ থানায় হস্তান্তর করে। বনগাঁ থানার পুলিশ আমাকে জানায়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসটিএফ আমাকে তাদের কাছে তুলে দিয়েছে। এরপর তারা আমাকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে মামলা দেয়। আমি কখনোই ভারতের মাটি ছুঁইনি, তবু আমাকে সে দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধী বানানো হলো।’
মেহেদীকে তখন বনগাঁ জেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে দমদম জেলে কাটাতে হয় চার মাস। তিনি বলেন, ‘জেলের প্রতিটি দিন ছিল অমানবিক কষ্টের। আমি কেবল অপেক্ষা করতাম মুক্তির দিনের জন্য। আমি জানতাম না, আমার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র শেষ হবে কবে।’
রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে অনৈতিক লেনদেনের খবর উস্কানিমূলক: রসাটম
অবশেষে চার মাস পর মেহেদী ভারতের দমদম জেল থেকে মুক্তি পান এবং ভারতের প্রশাসন ও বিএসএফ সদস্যরা তাকে মেহেরপুর মুজিবনগর সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করে। সীমান্ত পার হওয়ার পর তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট, দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের পর তিনি তার বাড়িতে ফিরেন’ সূত্র : আমার দেশ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।