জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য একজন মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। একজন ব্যক্তি কীভাবে চাপ মানিয়ে নেবেন, অন্যের সঙ্গে মিশবেন এবং সুস্থ জীবন যাপন করবেন—সবকিছুতেই মানসিক স্বাস্থ্যের ভূমিকা ব্যাপক।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন অত্যাবশকীয় একটি বিষয়। আমাদের প্রতিদিন বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা আমাদের মনে সুখানুভূতি তৈরি করে, আবার কোনো কোনো ঘটনা আমাদের মনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না, এমন কিছু ঘটনাও ঘটে যার কারণে আমাদের মনে বিষাদ, রাগ-ক্ষোভ কিংবা দুঃখের কালো মেঘ নিয়ে আসে। যখন আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হব, তখন এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা সহজ হবে, দ্রম্নত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব হবে।
যে কারো জীবনে দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা- নৈরাশ্যের কালো মেঘ বাসা বাঁধতে পারে, তাই বলে জীবন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায় না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা কীভাবে খারাপ সময় বা পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি কতটা যত্নবান হচ্ছি। মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের জীবনের সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষা করে এবং জীবনকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে।
মানসিক স্বাস্থ্য একজন ব্যক্তির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ১৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষই কোনো ধরনের সেবা বা পরামর্শ নেন না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, মানসিক স্বাস্থ্য যত বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে, আত্মহত্যার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের সমস্যার মোকাবিলা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে প্রভাবিত করে। মানসিক স্বাস্থ্য এমন একটি বিষয় যা আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হয়। যদি কারো মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তখন তারা আরো বেশি উপেক্ষিত হয়, তির্যক মন্তব্যের শিকার হয়। এমনকি কখনো কখনো বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত সহ্য করতে হয়।
তবে আশার বাণী হলো, দেরিতে হলেও মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিনিয়ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একেবারেই অপ্রতুল। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিতে আমাদের সবাইকে আরো বেশি এগিয়ে আসতে হবে।
যাতে কেউ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় থাকা ব্যক্তিকে অবজ্ঞা করতে না পারে। এটি বিশ্বাস করতে হবে মানসিক সমস্যায় ভোগা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতার মতো, বিভিন্ন সময় মানসিক অসুস্থতাও তৈরি হতে পারে। এটি লুকিয়ে রাখার কোনো বিষয় নয়, বরং লুকিয়ে রাখলেই বিপদ!
তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, জীবনের বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি আমাদের জীবন সম্পর্কে আরও বেশি অভিজ্ঞ করে তুলে। সমস্যার মোকাবিলায় সর্বাবস্থায় আবেগকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কখনো কখনো আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়, তাই বলে মাঝপথে হার মানা যাবে না। জীবন চলার পথে আমাদের বারবার উঠে দাঁড়াতে হয়। শত ব্যর্থতা ভুলে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচন করতে হবে। পরবর্তী সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া যাবে না।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করার প্রধান তিনটি কারণ রয়েছে প্রথমত, মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। যদি কারো শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধে, এজন্য আমরা তাকে কিংবা তার শরীরকে দায়ী করি না, তাহলে আমরা কেন মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যার জন্য ব্যক্তি বা তার মস্তিষ্ককে দায়ী করি? কেন সহজেই বলে ফেলি, তার মাথায় সমস্যা। মানসিক অসুস্থতা অন্য দু’চারটে রোগের মতোই।
সুচিকিৎসার অভাবে, অন্যান্য রোগের ন্যায় এটিও জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হতাশা। দীর্ঘকালীন হতাশার ব্যাধি এক সময় মানুষকে আত্মহত্যার প্রবণতার দিকে নিয়ে যায়। যদি সঠিক চিকিৎসা করা না হয়, ব্যক্তি শুধুমাত্র আত্মহত্যার ধারণায় আটকে না থেকে সরাসরি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। মন এবং শরীরের সংযোগ অবিচ্ছেদ্য। অনেক মানসিক অসুস্থতা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তার মানে আরো ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্যে পড়া এবং অসুখকে সামাল দেওয়ার শরীরের বিদ্যমান ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।
ওয়েবএমডি অনুসারে, ‘উদ্বেগের ফলে শরীরের স্ট্রেস হরমোনসমূহের নিঃসরণ ঘটে- যা হৃৎস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে দেয়, রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে, বাহু এবং পায়ে অধিক পরিমাণে রক্ত সঞ্চালন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গ হৃৎপিন্ড, রক্তনালি, পেশি এবং অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে।’
আমাদের শরীরে যখন উদ্বেগের অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন আমরা সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করি। বিনা চিকিৎসায় থাকলে, মানসিক সমস্যা আশপাশসহ সমস্ত কিছু থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। অনেকে মানসিক সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে ড্রাগ এবং অ্যালকোহলের আশ্রয় নেয়- যা তাদের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য এবং স্থিরতাকে নষ্ট করে দেয়।
নিজেকে ভুল পথে পরিচালিত করতে গিয়ে, তখন আরো বেশি সমস্যার বৃত্তে আটকে যেতে হয়। এমন অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার পর মানুষ বুঝতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি মানসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমাদের ভুগতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নেতিবাচক পূর্ব ধারণা এবং লজ্জা সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। যাতে ভুক্তভোগী ব্যক্তি তার সমস্যা নিয়ে কথা বলার পরিবেশ পায়। মানসিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তি, যখন তার সমস্যার ব্যাপারে কথা বলতে লজ্জা পায়, তখন তিনি নিজেকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন। ব্যক্তি এতটা হীনম্মন্যতায় ভোগেন যে, নিজের সামর্থ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন।
যখন এই বিষয়টি সামনে আসবে, মানসিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তির যথাযথ চিকিৎসা দরকার। কিন্তু আমাদের আশপাশের মানুষকে সচেতন করা না গেলে এবং নেতিবাচক ধারণা দূর করতে না পারলে, কেউ মানসিক সমস্যায় ভোগার ব্যাপারটি সহজে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না, এটি নেতিবাচক বদ্ধমূল ধারণাকে আরও বেশি পাকাপোক্ত করবে। যখন আমরা কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে কথা বলতে চাই না, তখন বিষয়টির অবস্থান আরও বেশি শক্তিশালী হয়।
যখন আমরা একে অন্যের সঙ্গে আমাদের সমস্যার বিষয়ে কথা বলতে পারি, সমস্যাটি ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে, আমরা নিজেদের লজ্জার মধ্যে আটকে না রেখে, অন্যদের সঙ্গে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
আমরা যখন প্রকৃত অবস্থায় ফিরে যাই, পুনরায় আমরা জীবনের সব দাবি পেশ করতে পারি। মানসিক স্বাস্থ্যের অস্তিত্ব এবং গুরুত্বকে অস্বীকার করতে গিয়ে, মূলত আমরা নিজেদের অবজ্ঞা করি। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।
যখন আমরা এভাবে বিশ্বাস করতে পারব এবং বলতে সক্ষম হব, তখন আমাদের মনোবল বাড়বে এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সমস্যা সৃষ্টিকারী উপাদান এবং সতর্কতা সংকেত সম্পর্কে জানতে পারব, ফলে আমরা ভেঙে পড়ব না এবং যারা সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাদের সম্পর্কে আরো সহানুভূতি তৈরি হবে। যা পৃথিবীকে আরো বেশি সংযুক্ত করবে।
তৃতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্য সব কিছুকে প্রভাবিত করে : মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের জীবন পরিচালনার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। সুচিকিৎসার অভাব হতাশা, দুঃখবোধ, অকর্মণ্যতা, অপরাধবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতাকে বাড়িয়ে তুলে। আমাদের সম্পর্কগুলোতে এর প্রভাব পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রে আমাদের ফলাফলের অবনতি হয়। সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রবণতা দেখা দেয়।
আগে আমরা যেসব বিষয় উপভোগ করতাম, তা এখন আর উপভোগ্য মনে হয় না। আমাদের পক্ষে মনোযোগ ধরে রাখা কষ্ট হয়ে যায়। আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে, ঘুমের পরিমাণ অতিমাত্রায় হ্রাস কিংবা বৃদ্ধি ঘটে। শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। মুহূর্তেই বিভিন্ন রকম চিন্তার উদ্রেক হতে পারে এবং চিন্তার দ্রম্নত পরিবর্তন ঘটতে পারে। নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। ড্রাগ, অ্যালকোহল অতি মাত্রায় ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে এবং আত্মহত্যা এর চূড়ান্ত পরিণতি।
সামগ্রিকভাবে এসব ঘটনা খুব সহজেই ঘটতে পারে, যদি আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব না দিই। আপনি যদি এসব সমস্যার কোনো একটি নিয়েও ভুগতে থাকেন, এখনি আপনাকে সাহায্য নিতে হবে। সুচিকিৎসা এবং যথাযথ চেষ্টার ফলে এসব সমস্যা থেকে অবশ্যই উত্তরণ সম্ভব। যখন আমরা সমস্যা কাটিয়ে উঠব, আমাদের জীবনের এর ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে এবং আমাদের জীবনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটিবে। আমাদের মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা বাড়বে। সবদিক থেকে আমরা আরো স্বাস্থ্যবান হতে পারব।
আমাদের সম্পর্কগুলো আরো মসৃণ হবে। আমাদের প্রতিদিনকার জীবন হবে অর্থপূর্ণ। আমাদের আশপাশের মানুষের সঙ্গে নিজেকে অধিকতর সংযুক্ত করতে পারব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রে আমরা অধিক কার্যক্ষম থাকতে পারব। সর্বোপরি আমরা যেমন মানুষ হতে চাই, নিজেকে তেমনিভাবে খুঁজে পাব। যখন আমরা ভালো বোধ করি, তখন আমরা নিজের সক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করতে পারি।
তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কোনো কিছুই রাতারাতি সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ন্যায় মানসিক স্বাস্থ্য সমান গুরুত্বপূর্ণ, এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সব কুসংস্কার, নেতিবাচক বদ্ধমূল ধারণা দূর করে, আশার সঞ্চার করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দিলে, আমরা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না। তাই এখনি সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।