জুমবাংলা ডেস্ক: রেল পরিবহন ব্যবস্থা অন্যান্য ব্যবস্থার তুলনায় বিপুলসংখ্যক যাত্রী বহন করে এবং দীর্ঘ দূরত্বের জন্য বড় ও ভারী লোড বহন করতে পারে বিধায় এটি জনপ্রিয়। তাই শুরু থেকেই রেলওয়ে সিস্টেম আকৃতি, গতি, চলার প্রকৃতি, সময় বাঁচানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ পরিবর্তন সাধন করেছে। এ পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক উত্থান হলো মেট্রোরেল।
মেট্রো শব্দটি আসলে ‘প্যারিস মেট্রোপলিটান’ এর একটি সংক্ষিপ্ত নাম, যা দ্রুতই মেট্রোতে রূপান্তরিত হয়, যা পরবর্তীতে সমস্ত পাতাল নেটওয়ার্ককে সংজ্ঞায়িত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটাকে দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম বলা হয়। এপ্রিল ২০১৪ অনুযায়ী, ৫৫ টি দেশে ১৬৮টি মেট্রো সিস্টেম তালিকাভুক্ত আছে।
আসুন, আমরা পৃথিবীতে মেট্রো সিস্টেমের উত্স, উৎপত্তি ও ইতিহাসের মধ্যে একটি তুলনামুলক আলোচনা করি।
ওয়ার্ল্ডের প্রথম শহুরে ভূগর্ভস্থ রেলওয়ে হলো মেট্রোপলিটান রেলওয়ে যা ১৮৬৩ সালের ১০ জানুয়ারি। প্যাডিংটন থেকে ফারিংডন পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার বিশেষ রেলপথ খুলে দেওয়া হলো জনগণের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। প্রথমদিনেই চলাচল করে ৩৮ হাজার যাত্রী। আর প্রথম বছরে যাতায়াত করে ৯৫ লাখ। দ্বিতীয় বছর সে সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ২০ লাখে। এখান থেকেই শুরু মেট্রোরেলের রূপকথার।
নর্স পুরাণে উল্লেখিত থরের রথটা যেন বাস্তবেই তৈরি করে ফেলেছে মানুষ। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। লন্ডনের চৌহদ্দি ছাপিয়ে বাতাসের বেগে মেট্রোরেল ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। সময়কে জয় করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা মানুষের। চাকা আবিষ্কার তাই যথেষ্ট নয়। মানুষ চেয়েছে গতি, চেয়েছে দূরত্বের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে। সেই আকাঙ্ক্ষারই ফলাফল হয়ে ধরা দেয় মেট্রোরেল।
শিল্প বিপ্লবের পর রূপকথার মতো সমৃদ্ধি অর্জন করে ইউরোপ। বিশেষ করে আয়তন ও জনসংখ্যায় অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে ওঠে লন্ডন। নগরীর রাস্তাগুলোয় ক্রমেই বেড়ে উঠতে থাকে যানজট। প্রতিদিন ভিড় লেগে থাকে গাড়ি ও ট্রেনে। ১৮৫০ সাল নাগাদ অন্তত সাতটি রেললাইন প্রতিষ্ঠার পরও বর্ধমান চাপ সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। নতুন রেলপথ স্থাপনেও নারাজ কর্তৃপক্ষ। বিকল্প হিসেবে আন্ডারগ্রাউন্ড রেল যোগাযোগের ধারণা নিয়ে হাজির হন চার্লস পিয়ারসন।
বিল পাস হয় ১৮৫২ সালে। ঠিক পরের বছর রেলওয়ে কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা একটা বৈঠক করে ইঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত করেন জন ফাউলারকে। টানাপড়েনের পর সংসদ থেকেও পাওয়া যায় অনুমতি। নর্থ মেট্রোপলিটন রেলওয়ে অ্যাক্টের অধীনে ১৮৫৪ সালের ৭ আগস্ট জন্ম নেয় মেট্রোপলিটন রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ। ১৮৬২ সালে শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত খরচ পড়েছে ১৩ লাখ পাউন্ড।
পরিচালনা পর্ষদের নজরদারি ও নিরাপত্তাবিষয়ক সতর্কতা শেষে ১০ জানুয়ারি পরিবহনের উপযুক্ত ঘোষণা করা হয় মেট্রোরেলকে। অবশ্য যার মস্তিষ্কপ্রসূত এ আয়োজন, সেই চার্লস পিয়ারসন দেখে যেতে পারেননি। ঠিক আগের বছর সেপ্টেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন মেট্রোরেলের স্বপ্নদ্রষ্টা।
লন্ডনের সফলতার গল্প অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। ১৯৭২ সালের জুলাইয়ে নেয়া হয় নতুন উদ্যোগ দ্য মেট্রোপলিটান রেলওয়ে অব কনস্টান্টিনোপল টু গালাট পেরা। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে এর কাজ শেষ হয়। যাত্রী পরিবহন শুরু করে ১৮৭৫ সালের ১৭ জানুয়ারি। আটলান্টিকের অন্য পাশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছে যায় জয়রথ।
১৮৯৭ সালে বোস্টনে নির্মিত সাবওয়ে টানেল এখন পর্যন্ত ব্যবহূত হচ্ছে। আমেরিকার সবচেয়ে পুরনো মেট্রো প্রকল্প এটি। এর সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে যাত্রা করেছে আধুনিকতর সাবওয়ে লাইন। বিশেষ করে নিউইয়র্ক শহরে নয় মাইল বিস্তার নিয়ে রয়েছে চার ট্র্যাকের লাইন।
দক্ষিণ গোলার্ধে সবচেয়ে পুরনো সাবওয়ে অবস্থিত আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে। ১৯১৩ সালে নির্মিত সাবওয়েটি প্রতিদিন এক লাখ ৯০ হাজার যাত্রী পরিবহন করে। এর ঠিক পাঁচ বছর পরে ১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর চালু হয় মাদ্রিদ মেট্রো। পৃথিবীর দীর্ঘতম মেট্রোগুলোর একটি এটি। স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফানসো নিজে তত্ত্বাবধান করেন প্রকল্পটি।
১৯২৪ সালে চালু হয় বার্সেলোনা মেট্রো। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ আধুনিকায়নের বাতাস আমেরিকা ও ইউরোপের মাটি ছেড়ে হানা দেয় সোভিয়েত ইউনিয়নেও। ১৯৩৫ সালে মস্কোয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া মস্কো মেট্রো পৃথিবীর সবচেয়ে নান্দনিক মেট্রোগুলোর একটি। বিশেষ সজ্জা ও আলোকায়নের জন্য মেট্রোর স্টেশনকে ভূগর্ভস্থ স্বর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, মস্কো মেট্রোয় ৩০৮ কিলোমিটার রেলপথ ও ১৮৬টি স্টেশন। বিশ্বের ব্যস্ততম মেট্রোর তালিকায়ও রয়েছে এর নাম। ২০ শতকের পরবর্তী দিনগুলোয় চারদিকেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে মেট্রোরেল। একই সঙ্গে আসতে থাকে বিবর্তন।
১৯৫৪ সালে নির্মাণ শেষ হয় টরন্টো সাবওয়ের কাজ। কানাডার দ্বিতীয় সাবওয়ে হিসেবে মন্ট্রিল মেট্রোর যাত্রা ১৯৬৬ সালে। দক্ষিণ আমেরিকার পরাশক্তি ব্রাজিল অবশ্য এদিক থেকে পিছিয়ে ছিল। মেট্রোর এ মিছিলে দেশটি যুক্ত হয় ১৯৭৪ সালে। কাছাকাছি সময়েই চিলিতে স্থাপিত হয় মেট্রো ডি সান্তিয়াগো। ৮৫টি স্টেশন ও পাঁচটি লাইন নিয়ে নির্মিত এ মেট্রো। দক্ষিণ আমেরিকায় রাবারের টায়ারযুক্ত একমাত্র মেট্রোও এটি।
আফ্রিকার দেশ হিসেবে মেট্রোয় প্রথম নাম লেখায় মিসর। ১৯৮৭ সালে কায়রোয় চালু হয় মেট্রোরেল। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে মেট্রোরেলে নাম লেখায় জাপান। ১৯২৭ সালে সাবওয়ে লাইন প্রতিষ্ঠিত হয় টোকিওতে। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৩৩ সালে ওসাকায় নির্মিত হয় দ্বিতীয় মেট্রো। এ জগতে চীনের যাত্রা দেরিতেই বলতে হবে। দেশটির প্রথম মেট্রো বেইজিং সাবওয়ে যাত্রা করে ১৯৭১ সালে। তবে খুব দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরে।
১৯৭৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি শহরেও চালু হয় যোগাযোগের এ নতুন স্রোত। ক্রমে যুক্ত হয় আরো কিছু দেশের নাম। সিঙ্গাপুরে ১৯৮৭ সালে প্রথম হেভি রেল সিস্টেম চালু হয়। তাইওয়ানে মেট্রোরেলের যাত্রা ১৯৯৬ সালে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে মেট্রো চালু হয় ১৯৯৯ সালে, আরব আমিরাতে ২০০৯ ও সৌদি আরবে ২০১১ সালে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রথম শুরু হয় কলকাতা মেট্রো।
১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন এলাট্টুভালাপিল শ্রীধরন। তাই মেট্রোম্যান হিসেবেই অধিক পরিচিত তিনি। ২০০২ সালে সম্পূর্ণ আধুনিকতা নিয়ে চালু হয় দিল্লি মেট্রো। মেট্রোরেলের দীর্ঘ ইতিহাস বিবর্তিতও হয়েছে নানাভাবে। যুক্ত হয়েছে নানা রকম সুবিধা। হংকং যুক্ত করেছে থ্রিজি সেবা। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিবর্তনে মেট্রোরেল একটা বিস্ময়কর গল্পের নাম। সেই গল্পে এবার যুক্ত হলো বাংলাদেশের নাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।