ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাসায় ঢুকে মা–মেয়েকে হত্যার ঘটনাটি তদন্তকারীদেরও স্তম্ভিত করে দিয়েছে। মরদেহের সুরতহাল ও আঘাতের ধরন ইঙ্গিত দিচ্ছে, হত্যাকারী হয় প্রশিক্ষিত কোনো কিলার, নয়তো অতিরিক্ত ক্ষোভে উন্মত্ত কোনো সাইকোপ্যাথ।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে বোরকা পরে বাসায় কাজে ঢোকেন আয়েশা নামের এক তরুণী। দেড় ঘণ্টা পর একই বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন স্কুলড্রেস পরে—কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো অবস্থায়। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই ঘটে যায় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। খবর পেয়ে পুলিশ বাসায় গিয়ে উদ্ধার করে মা–মেয়ের রক্তাক্ত মরদেহ।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত এই নৃশংসতার নেপথ্যের প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। তবে তদন্তকারীদের বক্তব্য, সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে এমন নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন প্রায় অসম্ভব।
নিহতরা হলেন—লায়লা আফরোজ (৪৮) এবং তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫)। নাফিসা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন, আর লায়লা আফরোজ ছিলেন গৃহিণী।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কৌশল ও আঘাতের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এটি পরিকল্পিতভাবে, অত্যন্ত দ্রুত এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত শত্রুতা, প্রতিশোধ, মানসিক বিকারগ্রস্ততা—সব ধরনের সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মোহাম্মদপুরের শান্ত আবাসিক এলাকায় এমন ভয়ংকর হত্যার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয়দের মাঝে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ইতোমধ্যে তদন্তে নেমেছে, সংগ্রহ করা হচ্ছে সিসিটিভি ফুটেজ, জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে আশপাশের বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের।
মা ও মেয়ের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে এসেছে লোমহর্ষক তথ্য। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এমন সুরতহাল সাম্প্রতিক সময়ে তারা দেখেননি। নিহত মা লায়লা আফরোজের শরীরে অন্তত ৩০টি জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাম গালে ৩টি, থুতনিতে ৪টি, গলার নিচে ৫টি, বাম হাতে ৩টি, দুই হাতের কব্জিতে মোট ৩টি, বুকের বাম পাশে ৯টি, পেটের বাম পাশে ২টি এবং তলপেটে ১টি গভীর আঘাত রয়েছে।
অন্যদিকে, মেয়ে নাফিসার গলা ও বুকের দুই পাশসহ শরীরে ৬টি গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করা হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ময়নাতদন্তকারী সূত্র। সোমবার রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে দুটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। এর একটি সাধারণ সবজি কাটার ছুরি হলেও অন্যটি একটি বিশেষ ধরনের ‘সুইচ গিয়ার’। এটি আঙুলের মধ্যে এমনভাবে আটকে ব্যবহার করা হয়, যাতে আঘাতের সময় হাত থেকে ফসকে না যায়।
তদন্তকারীদের মতে, এই ধরনের অস্ত্র সচরাচর বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা হয় না। ঘাতক সম্ভবত বাইরে থেকেই পরিকল্পিতভাবে এই অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। অস্ত্রের ধরন এবং ব্যবহারের কায়দা দেখে পুলিশের ধারণা, ঘাতক প্রশিক্ষিত অথবা সে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত (সাইকোপ্যাথ) হয়ে অতিরিক্ত ক্ষোভ থেকে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।
তদন্তে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতক অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় বাথরুমে প্রবেশ করে। সেখানে সে গোসল করে এবং নিজের রক্তমাখা পোশাক পরিবর্তন করে নিহত মেয়ের স্কুল ড্রেস পরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এই ঘটনায় কথিত গৃহকর্মী আয়েশাকে আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার ইবনে মিজান জানান, হত্যার ধরন ও নৃশংসতা দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ঘাতক প্রশিক্ষিত হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি। হত্যার আগে ও পরে সন্দেহভাজনের উপস্থিতি ও কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেহেতু ঘাতক মেয়ের স্কুল ড্রেস পরে পালিয়েছে এবং বিশেষ অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তাই এটি পরিকল্পিত হতে পারে।
পুলিশ আশা করছে, পলাতক গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা গেলেই এই নৃশংস জোড়া খুনের নেপথ্যের আসল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



