স্যার আইজ্যাক নিউটন মহাকর্ষ সূত্র প্রকাশ করে গেছেন। সেই সূত্রটা আমাদের পরিচিত। সূত্রটায় যে দুটো বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষ বল মাপতে চাওয়া হয়, তাদের ভর ও মহাকর্ষীয় ধ্রুবক গুণ করতে হয়। তারপর বস্তু দুটোর দূরত্বের বর্গ দিয়ে ভাগ করে দিলেই হলো।
ঘটনা হলো, নিউটন কিন্তু নিজে এই মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান বের করার কোনো চেষ্টা করেননি। পৃথিবীর ভরও মাপতে চাননি। ১৭ শতকে এসে বিজ্ঞানীদের এই কৌতূহল মাথাচাড়া দেয়। তখন নানা জন নানাভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। কেউ কেউ প্রস্তাব করেন, ভর মাপার জন্য ঘনত্ব মাপা যেতে পারে। ১৭৭২ সালে রয়্যাল সোসাইটি রীতিমতো ‘কমিটি অব অ্যাট্রাকশন’ বা আকর্ষণ পরিষদ গঠন করে। তাদের কাজ, পৃথিবীর আকর্ষণ ও ঘনত্ব পরিমাপ করা।
এ সময় একটা প্রস্তাব আসে, খুব সুষম গঠনের একটা পাহাড়ের ওপর পেন্ডুলাম দুলিয়ে ওটার ওপর মাধ্যাকর্ষণের টান পরিমাপ করা যেতে পারে। যদিও এই প্রভাব হবে খুব সামান্য। সেই পরিষদ কিন্তু তাতে দমে যায়নি। ক্যাভেন্ডিসও সেই দলে ছিলেন। তাঁরা স্কটল্যান্ডের বিশাল এক পর্বতের ওপর এরকম পেন্ডুলাম দুলিয়ে হিসাব করে দেখলেন, পৃথিবীর ঘনত্ব পানির সাড়ে ৪ গুণ। (এটা সঠিক হিসাব নয়।) ক্যাভেন্ডিস দেখলেন, এই পরীক্ষায় এমন কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করা হয়েছে, যেগুলোর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। কাজেই, তিনি বুঝলেন, এভাবে হবে না।
বয়স বাড়ছে। ক্যাভেন্ডিস ভাবছেন কী করা যায়। মেঘে মেঘে হোক কিংবা সমুদ্রে পানি গড়িয়ে হোক, ক্যাভেন্ডিসের বয়স যখন ৬৭, তখন তাঁর মাথায় চমৎকার এক আইডিয়া এল। বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইডিয়া। ক্যাভেন্ডিস তাঁর আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করলেন। এক বন্ধু—ভূতত্ত্ববিদ রেভারেন্ড (পাদ্রী) জন মিচেল—তাঁকে একটা টরসন ব্যালেন্স দিয়েছিলেন। জিনিসটা তাঁর কাজের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ক্যাভেন্ডিস সেটাকে একটু ঠিকঠাক করে নিলেন প্রথমে।
এখন কথা হলো, টরসন ব্যালেন্স জিনিসটা কী? এই যন্ত্রে ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের একটা কাঠের দণ্ড ছিল। আড়াআড়িভাবে দণ্ডটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা তার দিয়ে। এই দণ্ডের দুই প্রান্তে যুক্ত ছিল ২ ইঞ্চি ব্যাসের ০.৭৩ কেজি ভরের দুটো সীসার বল।
তারপর তিনি ছবির মতো করে ছোট বল দুটোর সঙ্গে দুটো বড় সীসার বল বিপরীতভাবে দুপাশে আটকে দিলেন। এই বল দুটোর ব্যাস ১২ ইঞ্চি, ভর ১৫৮ কেজির মতো। এখানে আইডিয়াটা হলো, বল দুটোর পারস্পরিক আকর্ষণের কারণে সুতোটা সামান্য মোচড় খাবে। এরকম দুটো সাধারণ বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষ বল আসলে অতি অতি সামান্য। কিন্তু বল দুটোর মধ্যকার আকর্ষণ বল পরিমাপ করা সম্ভব।
ক্যাভেন্ডিস দিন-রাত এই পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করে আকর্ষণ বল মাপলেন। বস্তু দুটোর ভর তিনি জানেন, জানেন এদের দূরত্ব। এর মাধ্যমে সহজেই হিসাব করে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, G-এর মান বের করে ফেলা সম্ভব। এখান থেকে এবারে শুধু আরেকটি সূত্রে G-এর মান বসানোর অপেক্ষা। সূত্রটি হয়তো অনেকেরই পরিচিত। এই সূত্রে বসিয়ে পৃথিবীর ভর বা ঘনত্ব হিসাব করেছেন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী।
ক্যাভেন্ডিসের এই পরীক্ষাটিকে পরে বিজ্ঞানীরা আরও উন্নত করেছেন, আরও ভালোভাবে করে দেখেছেন। মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, G-এর মান এই বিজ্ঞানীর পরীক্ষা থেকে আদর্শ হিসাবে গৃহীত হয়নি, হয়েছে আরও ৭৫ বছর পরে এসে। একটা কারণ তো আগেই বললাম, তিনি বিষয়টাকে পৃথিবীর ঘনত্বের পরিমাপ হিসেবে প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয় কারণ, ৫৭ পৃষ্ঠার সেই গবেষণাপত্রে তিনি এই পরীক্ষার নাম দিয়েছিলেন ‘ওয়েইং দ্য ওয়ার্ল্ড’, যার অর্থ বিশ্বের ওজন পরিমাপ। রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল বইতে লিখেছেন, পরীক্ষাটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ওয়েইং দ্য আর্থ’ বা পৃথিবীর ওজন পরিমাপ।
ফাইনম্যানের ভাষায় ক্যাভেন্ডিস তাঁর এ পরীক্ষার নাম দিয়েছিলেন ‘পৃথিবীর ওজন মাপা’। আজকের দিনের যত্নশীল ও খুঁতখুঁতে শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা শিক্ষার্থীদের এটা বলতে দিই না। আমাদের বলতে হয় ‘পৃথিবীর ভর পরিমাপ’। ভরকে ওজন বলার চিরায়ত রীতি যে ক্যাভেন্ডিসের মতো চিরায়ত ঘরানার মানুষ অনুসরণ করবেন, তা আর বলতে!
সে যাইহোক, বর্তমানে অবশ্য এ পরীক্ষাটিকে শুধুই মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান নির্ণয়ের পরীক্ষা হিসাবে দেখা হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, ক্যাভেন্ডিসের পরীক্ষা। সে যাই হোক, তাঁর এ পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রথম জানা গিয়েছিল, আমাদের পায়ের নিচের গোলকটি কতটা ভারী। সে জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাসে হেনরি ক্যাভেন্ডিস আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।