ফাহিমা আক্তার সুমি : আমদানিকৃত কিংবা দেশি, ফল মানেই রাসায়নিক মেশানো। কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকাতে, বেশিদিন সংরক্ষণ করতে ব্যবহার হচ্ছে নানা রাসায়নিক। এর মধ্যে অন্যতম অক্সিন বা মোমের প্রলেপ। যা ফলকে সুরক্ষিত রাখে। দীর্ঘদিন ফলগুলো থাকে সতেজ। এরপর রয়েছে ইথাপিন। অনেকে ব্যবহার করে কার্বাইড। আর ফরমালিন তো আছেই। এসব রাসায়নিক মেশানো ফল স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। রাসায়নিক মেশানো ফল খেয়ে নানা জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফল যখন গাছে আসে তখন পুষ্টি ও পোকামাকড় থেকে সুরক্ষিত রাখতে নানা ধরনের রাসায়নিক দেয়া হয়।
আবার ফলকে পাকানো ও পচনরোধের জন্য কার্বাইড বা ইথিন ও অনেক সময় ফরমালিনও দেয়া হয়। এর কোনোটিই মানুষের জন্য খাবারের উপযোগী নয়।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ লোক খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছে। ভেজাল খাবারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় খুব ধীরে ধীরে। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট, হাঁচি, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, অরুচি, ক্ষুধামন্দা, বদহজম, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, আলসার, লিভার সিরোসিস, অন্ধত্ব, ত্বক-চোখের জ্বালাপোড়া, লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি, রক্তশূন্যতা, পাকস্থলী, ফুসফুস, শ্বাসনালিতে ক্যান্সার ও ব্লাড ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি রোগ নিজের অজান্তেই দেহে বাসা বাঁধছে। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররাও। শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিসহ মস্তিষ্কের বিকাশও থেমে যায়। এমনকি মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ১৩টি দেশে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন জাতীয় কেমিক্যাল পদার্থ মিশানো হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, পাকিস্তানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সূত্র জানায়, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশি ফল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। এসব ফল আমদানি করার সময় তিন ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তা বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয়। এখানে ফল আসে ভারত, চীন, ভুটান, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, দুবাই, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, জর্ডান, কুয়েত, ফিলিপাইন ও ইরান থেকে।
বর্তমান মওসুমে বাজারে বাহারি ফলের সমাহার। কিছু ফল বারো মাসই বিক্রি হচ্ছে। আর মৌসুমি ফল নির্দিষ্ট সময়ে বাজার দখল করে। সব ফল যে দেশি তা নয়। কিছু ফল আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। আর বিদেশ থেকে আসা ফলেই মেশানো হয় অক্সিন বা মোম। এ ফলের মধ্যে রয়েছে আপেল। এই আপেল বেশিদিন সংরক্ষণ করতে ব্যবহার হচ্ছে রাসায়নিক ও প্রিজারভেটিভ। ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি করা ফল প্রিজারভেটিভ ছাড়া দেশে আসে না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, আপেলে কৃত্রিমভাবে অক্সিন বা মোমের প্রলেপ ব্যবহার করা হয়। এই অক্সিন ফলকে সুরক্ষিত রাখে। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ফলগুলো সতেজ থাকে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফল দেশে আসতে সময় লাগে ১৫ দিন থেকে ২ মাস পর্যন্ত। এ সময়ে রাসায়নিক মেশানোর ফলে ফলটি সতেজ থাকে। সবচেয়ে বড় কথাÑ বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোয় ফলে স্বাদ পাওয়া যায় না। এসব ফল খেয়ে নানা জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ক্রয়ের পরে কয়েক সপ্তাহ ধরে সতেজ থাকে এসব ফল। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশি ফলে পানির সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়ে স্প্রে করলে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে ফল পেকে যায়।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম সরকার মানবজমিনকে বলেন, অনেক ব্যবসায়ী বেশি লোভ থেকে ফল পাকানোর জন্য ইথাপেন ব্যবহার করে। অনেক সময় মাত্রাতিরিক্তও ব্যবহার করে। আবার অনেকে কার্বাইড ব্যবহার করে। যা খুবই ক্ষতিকর। এবং নিষিদ্ধ। শরীরে এটি প্রভাব ফেলে। কার্বাইড ব্যবহারকারীদের সন্ধান পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি বলেন, উদ্ভিদজাত বা ফল উৎপাদন এগুলোতে ফরমালিন দিলেও কাজ করে না। ফলে যেটা পরীক্ষা করে পাওয়া যায় এটি হলো ইনভিট, যা সব ফলেই থাকে। এটি এক এক ফলে একেক রকম দেয়া হয়। তিনি বলেন, ফলের মধ্যে যদি ফরমালিন দেয়া হয় এটি বাতাসের সঙ্গে মিশে যাবে। তবে মাছ, মাংস বা দুধ এসব প্রোটিন জাতীয় খাদ্যে ফরমালিন বিক্রিয়া করে। বর্তমানে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি অপরিপক্ব ফল যেন বাজারে না আনা হয়। কেউ আনলে তাদের প্রতি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিদেশ থেকে যে ফল আসে যেমন আপেল বাজার থেকে কিনে আনার পর ১৫-২৫ দিন টাটকা থাকে। তার কারণ প্রতিটি ফলে অক্সিন প্রলেপ থাকে। এই অক্সিন ফলটাকে সুরক্ষিত রাখে। তবে যে ফলের গায়ে ক্ষত বা দাগ পড়বে সেটি আর ভালো রাখা সম্ভব হয় না।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, অসংখ্য দেশি-বিদেশি ফলের সমাহার। বেশির ভাগ ক্রেতা জানান, বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোর ফলে পুষ্টি ও স্বাদ কোনোটাই ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকাতে এবং বেশিদিন সংরক্ষণ করতে কপার সালফেট, ইথাপেন, ইথানল, কার্বাইড, ফরমালিন, কার্বনের ধোঁয়াসহ বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করেন।
রাসেল নামের একজন ক্রেতা বলেন, ফল কিনতে ভয় পাই। ব্যবসায়ীরা কখন কোন ফলে কি মেশাচ্ছে সেটি কে জানে। দুইদিন আগে চারটি আনারস কিনেছিলাম সকাল হতেই দেখি পচে গেছে। অথচ কেনার সময় খুবই ভালো ছিল। লিচু কিনেও একই রকম অবস্থায় পড়েছি। ফলে কোনো স্বাদ-গন্ধ পাওয়া যায় না। আপেল, মাল্টা কিনলে বেশ কিছুদিন সতেজ থাকে, সহজে নষ্ট হয় না।
ফারজানা নামে একজন বলেন, বাসায় ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের সবসময় ফল খাওয়ার চাহিদা থাকে। কিন্তু ভয় হয়। ফল কাটার আগে আধাঘণ্টা ভিজিয়ে রাখি। কিছু ফল আনার একদিন পরেই নষ্ট হয়ে যায় আবার কিছু ফল অনেকদিন ভালো থাকে। এতদিনই বা কি করে ভালো থাকা সম্ভব। আঙ্গুর ফল নাকের কাছে নিলেই একটা মেডিসিনের গন্ধ পাই। উপরে সাদা সাদা দাগ দেখা যায়।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আড়ত থেকে আনার পর কয়েকদিন থাকলে ফল নষ্ট হয় না। আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুরসহ অমদানিকৃত ফলগুলো দেশে আসলে তাতে কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। ফল ভালো রাখতে বিদেশ থেকে সব প্রকার মেডিসিন ব্যবহার করে প্যাক করে দেয় রপ্তানিকারক দেশগুলো। সেগুলোর মেয়াদ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকে।
এরপর ফল পচে যায়। তবে দেশি কলা, আম, লিচু, পেঁপেসহ অন্যান্য ফল রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ও তাজা রাখা হয়। এক ব্যবসায়ী বলেন, পানির সঙ্গে মেডিসিনগুলো দিয়ে স্প্রে করলে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে ফল পেকে যায়। আবার ফলগুলো কাঁচা ও শক্ত রাখার জন্য আরেকটি মেডিসিন ব্যবহার করে। সব ফল মেডিসিন দিয়েই পাকানো হয়। আমদানিকৃত ফল একটিও মেডিসিন ছাড়া দেশে আসে না। তাদের অত্যাধুনিক হিমাগার ও রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে দেশে এসে ফলগুলো সহজে নষ্ট হয় না। তিনি আরও বলেন, স্প্রে না করে কোনো আম আমদানি বা বাজারজাত করা হয় না। আম পাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে এটি দ্বিগুণ দামে বিক্রি হবে। তখন কোনো সাধারণ মানুষ কিনে খেতে পারবে না। একদম পাকা আম কখনো আমদানি-রপ্তানি করা যায় না। যার জন্য কাঁচা আমে রাসায়নিক ব্যবহারের পর প্যাকেট করে আমদানি-রপ্তানি করা হয়।
বিএসটিআই’র উপ-পরিচালক মো. রিয়াজুল হক বলেন, আমরা বাজার থেকে নিয়মিত ফল ক্রয় করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। এটি সারা বছরই ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। দেশীয় এবং আমদানিকৃত উভয় ফলই পরীক্ষা করা হয়। গত এক বছরের মধ্যে আমরা ফলে কোনো ফরমালিন উপস্থিতি পাইনি।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশনের দপ্তর সম্পাদক রাকিব হোসেন বলেন, বাদামতলীতে দেড় হাজারের মতো দোকান আছে। সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রি হয়। শুধু এখানে না বিদেশি ফলগুলো চট্টগ্রাম পোর্টেও আসে। দেশের দূরত্ব অনুযায়ী নির্ভর করে সময়ের। কোনো কোনো দেশ থেকে আসতে ১৫ দিন থেকে ২ মাসও সময় লেগে যায়। আমদানিকৃত ফলের ২০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। আর বাকিগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে আসে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ফল যখন গাছে আসে তখন পুষ্টি ও পোকামাকড় থেকে সুরক্ষিত রাখতে নানা ধরনের রাসায়নিক দেয়া হয়। এদিকে আবার ফলকে পাকানো ও পচনরোধের জন্য কার্বাইড বা ইথিন ও অনেক সময় ফরমালিনও দেয়া হয়। এর কোনোটি মানুষের জন্য খাবারের উপযোগী নয়। কার্বাইড থেকে যে উপাদানগুলো তৈরি হয় তাতে আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত পদার্থ থাকে। এগুলো খেলে পরিপাকতন্ত্রে অসুখ হয় তেমনি এলার্জি জাতীয় নানা সমস্যা দেখা যায়। বমি, মাথাব্যথা জাতীয় সমস্যা তৈরি হয়। এ ধরনের রাসায়নিক মিশ্রিত ফল নিয়মিত খেলে মানুষের কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হয়। এবং দেহে ক্যান্সার, ডায়রিয়া, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক শাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। বিষ মেশানো ফল খেয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। দিন দিন শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। শিশুদের এবং গর্ভবতী নারীদের শরীরে ফলের সঙ্গে ক্ষতিকারক রাসায়নিক প্রবেশ করে সেক্ষেত্রে মানসিক এবং শারীরিক বিকাশকে ব্যাহত করে। একই সঙ্গে তার পরিপাকতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার ফলে শারীরিক বিকাশ অনিশ্চিত হয়ে উঠে। ফলে শিশুর ভবিষ্যৎকে অসুস্থ করে তোলে। সূত্র-মানবজমিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।