জুমবাংলা ডেস্ক : লাশ না পেলে খাবার জোটে না ৬ জনের মুখে। আর লাশ পাওয়ার খবর পেলে খুশির ঢেউ বয়ে যায় সেদিন সংসারে। মানুষের পচা-গলা, রক্তাক্ত লাশ পাওয়ার ওপর সংসার চলে ৩৫ বছর ধরে। এই পরিবার কর্তার ডাক নাম ছকু। মফিজুল ইসলাম ছকু। বাড়ি গাইবান্ধা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে সাহাপাড়া ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে। এই গ্রামের টিনের ছোট ঘরে মফিজল হক ছকু মিয়ার সংসার। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখা শিখতে পারেনি অভাবের কারণে।
সে কারণে ছকুকে সংসারের টানেই তার বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে যেতে হতো। ছকুর বয়স যখন ২২ বছর তখন সে বুঝতে পারে রোদে পিঠ ও গা পুড়ে যায়। ধান কাটার কাজ করে যে টাকা পায় তাতে তার পোষায় না। কাজ অনুযায়ী দিনমজুরের দাম সব চেয়ে কম। তাই অন্য পেশা খুঁজতে থাকে । চালাতে থাকেন ভ্যান। ভ্যান চালাতে গিয়ে লাশ টানার কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একদিন পাশের গ্রামের এক ব্যক্তি তার নিজ বাড়িতে গলায় রশি দিয়ে ফাঁস দিয়ে মৃত্যুবরণ করে। আসে পুলিশ। ঝুলন্ত লাশ দড়ি খুলে নামানোর মতো লোক পাওয়া যাচ্ছিলো না। গায়ে গতরে বিশাল দেহের যুবক ছকুকে দেখে পুলিশ বলে লাশটা নামিয়ে দে টাকা পাবি। সেই প্রথম ছকুর লাশ টানার কাজ।
তারপর লাশ ফাঁসির দড়ি কেটে ঘাড়ে করে মাটিতে শুইয়ে দেয়। আশেপাশের লোকজন ছকুর সাহস দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। বাহবা দিতে থাকেন সবাই। সেই লাশ একাই ঘাড়ে করে নিয়ে তার ভ্যানে তুলে সোজা থানায়। সারারাত লাশের পাশে বসে থেকে পরদিন আবার লাশ নিয়ে নিহতের বাড়িতে ফেরেন। সেই থেকে শুরু ছকুর আরেক জীবন। সেজন্য তাকে মজুরি দেয়া হয় এক হাজার টাকা। এই টাকা নিয়ে ছকুতো মহা খুশি। বয়স বাড়তে থাকলেও ছকু মিয়ার কাজের কারণে তার বিয়ে হতে অনেক বিলম্ব হয়। অনেকগুলো বিয়ে তার ভেঙে যায় তার কাজের কথা শুনে। কিন্তু রেখা বেগম নামের এক মহিলা ছকু মিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়। ১৯৯৯ সালের এক দিন ছকু মিয়া ঘটা করে বিয়ে করেন ওই মহিলাকে। তারপর দীর্ঘ দিনের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক হন । বিয়ের রাতেই এক মহিলার পচা -গলা লাশের খবর দিয়েছে সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ। লাশটা নিয়ে আয় টাকা পাবি। ডাক পেতেই বাসর রাত ফেলে ভ্যান নিয়ে দৌড়।
আরেক দিনের গা শিউরে ওঠার গল্প বলেন ছকু মিয়া। মাথা কাটা বিকৃত এক মহিলার পচা-গলা দেহ পড়ে আছে ধান ক্ষেতে। দুর্গন্ধে ধারে কাছে যাওয়া যায় না। রাত তখন ১১টা। দূরে দাঁড়িয়ে পুলিশ ও গ্রামবাসী। কেউ কাছে আসে না। ছকু মিয়া কিছু কেরোসিন তেল ও চা পাতা কিনে নিয়ে লাশের আশেপাশে ছিটিয়ে দুর্গন্ধ কিছুটা দূর করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা কি আর হয়। এক হাতে টর্চ লাইট ও অন্য হাতে গলিত লাশ একটানে চাটাই দিয়ে মুড়িয়ে নেন। তারপর ঘাড়ে তুলে ভ্যানে শুইয়ে দেন। দুর্গন্ধে নিহত মহিলার স্বজনরাও কাছে না এলেও ছকু একাই গা ছমছম রাতে লাশ নিয়ে চলেন গাইবান্ধায় মর্গের দিকে। তারপর মর্গের সামনে লাশ রেখে সারারাত বসে থাকে ছকু মিয়া। কি জানি শেয়াল-কুকুর পচা গন্ধ পেয়ে টানা হেঁচড়া শুরু করে। সারারাত জেগে বসে পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে আবার ওই পচা লাশ পৌঁছে দেন তার স্বজনদের বাড়িতে। এজন্য তাকে দেয়া হয় মাত্র ৮ শ’ টাকা। ছকু বলেন, যে কাজ কেউ করে না, সেই কাজ করে আমার মজুরি তো বেশি পাবার কথা কিন্তু মজুরি টানা দুইদিনের খাটুনির দাম মাত্র ৮শ’ টাকা। তাই নিয়ে ভ্যান টেনে আবার বাড়ি ফেরা ।
কেরোসিন দিয়ে ভ্যান ধুয়ে নিজে সাবান দিয়ে গোসল করেন। তারপর খাবার। গলে যাওয়া, পচা, মুণ্ডুকাটা, গলায় ফাঁস লাগানো, রক্তাক্ত খুন হওয়া মানুষগুলোকে কাছ থেকে সহজেই ঘাড়ে তুলে পৌঁছে দেন মর্গে। তারপর আবার স্বজনদের বাড়িতে। এভাবে গত ৩৫ বছরে ছকু মিয়া অসংখ্য মৃত মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন সাহসের সঙ্গে। তার কথা লাশ কেউ বহন করতে চায় না, মরা মানুষের পাশে তার স্বজনরাও থাকে না কিন্তু আমাকে পাহারায় বসে থাকতে হয়। আমি মনে করি এ কাজটা শুধু টাকার বিনিময়ে নয়, এটি আমার সেবা। মরা মানুষের লাশ বহন করাকে তিনি সেবার্ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই বয়সে তিনি অন্তত হাজার নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোরীর মরদেহ ঘাড়ে তুলে নিয়ে গেছেন মর্গে। এতে তার কোনো দুঃখ নাই। কিন্তু তার আফসোস তার পরিচয় কি। কেউ জিঞ্জেস করলে বলতে পারে না তিনি কি কাজ করেন। সে কারণে তার ছেলেমেয়ে ও স্বজনদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এব্যাপারে গাইবান্ধা থানার ওসি খান মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন- ডোমরা হয়তো যা করে না ছকু মিয়া তাই করে। শুধু টাকার জন্য নয়, এটা তার সমাজসেবা বলে মনে হয়। সূত্র: মানবজমিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।