‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’—এই প্রবাদের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ শীতকাল নিজেই। রং-বেরঙের ফুলের সমারোহ, হরেকরকম তাজা শাকসবজির যেমন অভাব নেই, তেমনি আছে শীতের তীব্রতা, সুস্থতা, ত্বকের যত্ন নিয়ে হাজারো দুশ্চিন্তা। বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকায় এ সময় মুখ, ঠোঁট ও হাত-পা ফাটে। হিমেল বাতাসের কামড় থেকে ত্বককে বাঁচাতে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহার করি আমরা। এ তালিকার শুরুর দিকেই থাকবে পেট্রোলিয়াম জেলি ও গ্লিসারিন। ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রেখে ত্বককে ফেটে যাওয়া থেকে রক্ষা করে পেট্রোলিয়াম জেলি।
এটুকু তো বোঝা গেল। কিন্তু গ্লিসারিনের কাজ কী? ত্বকের ঠিক কী উপকার করে এ দ্রব্য? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব এ লেখায়। তার আগে গ্লিসারিনের পরিচয়টা জেনে নেওয়া যাক। এক কথায় বললে, গ্লিসারিন হলো স্বচ্ছ, আঠালো এবং মিষ্টি-স্বাদযুক্ত তরল। রাসায়নিকভাবে একে অবশ্য গ্লিসারিন বলা হয় না। এর প্রধান যৌগের নাম গ্লিসারল। ত্বকে ব্যবহৃত গ্লিসারিনের ৯৫ শতাংশই এই গ্লিসারল। হাইড্রক্সিল গ্রুপের অ্যালকোহল শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এ যৌগের রাসায়নিক সংকেত C₃H₈O₃। অর্থাৎ এটি একধরনের জৈব যৌগ, মানে কার্বন ও হাইড্রোজেনের যৌগ। এতে তিনটি কার্বন, আটটি হাইড্রোজেন ও তিনটি অক্সিজেন থাকে।
১৭৮৩ সালে জার্মান-সুইডিশ রসায়নবিদ কার্ল উইলহেলম শেল চর্বি বা ফ্যাট এবং শক্তিশালী ক্ষারের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটিয়ে গ্লিসারিন আবিষ্কার করেন। নামটা এসেছে অবশ্য আরও খানিকটা পরে। ১৮১১ সালে ফ্রেঞ্চ রসায়নবিদ মাইকেল-ইউজিন শেভ্রেওল এ নাম দেন। উইহেলম শেল তাঁর আবিষ্কৃত উপাদানকে চর্বির মিষ্টি উপাদান বা ‘সুইট প্রিন্সিপল অব ফ্যাট’ বলেছিলেন।
গ্লিসারিনের ব্যাপক উৎপাদন ও বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় উনিশ শতকের শুরুর দিকে। সে সময় মূলত সাবান ও বিস্ফোরক তৈরির উপাদান হিসেবে গ্লিসারিন কাজে লাগানো হতো। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্লিসারিনের চাহিদা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। যুদ্ধের বিভিন্ন বিস্ফোরক তৈরি ও অটোমোবাইল শিল্পে লুব্রিকেন্ট ও শীতক তরল হিসেবে ব্যবহার করা হতো এটি। বর্তমানেও গ্লিসারিনের নানারকম ব্যবহার আছে। তবে আজকের আলোচনা এ নিয়ে নয়।
গ্লিসারিন পাওয়া যায় মূলত দুভাবে। একদিকে প্রাণী ও উদ্ভিদের চর্বি বা তেল থেকে সাবান তৈরির সময় এটি উপজাত হিসেবে পাওয়া হয় (বিক্রিয়া থেকে পাওয়া প্রধান উপাদান ছাড়া যেসব উপাদান তৈরি হয়, সেগুলোই উপজাত)। অন্যদিকে, পেট্রোকেমিক্যাল থেকে প্রোপিলিন অক্সাইড ব্যবহার করে সিন্থেটিক বা কৃত্রিম পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয় এটি। আধুনিক কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহৃত, অর্থাৎ আমরা যে গ্লিসারিন ত্বকে মাখি, তা সাধারণত উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে আসে। কারণ, এটি তুলনামূলক পরিবেশবান্ধব ও ত্বকের জন্য নিরাপদ।
গ্লিসারিন ত্বকে প্রাকৃতিক আর্দ্রতাকারক হিসেবে কাজ করে। পরিবেশ থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে ত্বকের বাইরের স্তরে পাঠিয়ে দেয়। ফলে ত্বক আর্দ্র থাকে। শুষ্ক ত্বকের জন্য গ্লিসারিন তাই বেশ উপকারী। আর্দ্রতা জুগিয়ে এটি ত্বকের বাইরের স্তরকে শুষ্কতাজনিত ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়। একই কারণে ত্বক আরও নরম ও মসৃণ হয়ে ওঠে। আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজির তথ্যানুসারে, ত্বকের ছোটখাটো ক্ষত নিরাময়েও গ্লিসারিন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নতুন কোষ গঠনে সহায়তা করে ও দ্রুত নিরাময় নিশ্চিত করে। এ ছাড়া এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য ব্রণ প্রতিরোধ করে বলে দাবি করা হয়।
২০১৬ সালে জার্নাল অব ডার্মাটোলজিক্যাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, গ্লিসারিন ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখার পাশাপাশি ত্বকের ব্যারিয়ার ফাংশন শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এই ব্যারিয়ার ফাংশন আসলে একধরনের প্রতিরক্ষা স্তর। ২০১৮ সালের ক্লিনিক্যাল, কসমেটিক অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনাল ডার্মাটোলজি জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, এটি ত্বককে পরিবেশগত নানা ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ত্বকে গ্লিসারিন ব্যবহারের নানা উপকার থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। গ্লিসারিন মূলত সবচেয়ে কাছের উৎস থেকে আর্দ্রতা সংগ্রহ করে। ফলে পরিবেশে বাতাস খুব শুষ্ক হলে এটি ত্বকের নিচের স্তর থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে ওপরের স্তরকে আর্দ্র করার চেষ্টা করে। তাই সামগ্রিকভাবে ত্বক আরও শুষ্ক হয়। শীতকালে আমাদের দেশের বাতাসে আর্দ্রতা খুব কম থাকে। তাই, গ্লিসারিন শীতকালে ব্যবহারের আগে পানি মেশানোর ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞরা। এতে মিশ্রিত পানি থেকেই ত্বকে আর্দ্রতা তৈরি করতে পারে গ্লিসারিন। ত্বকও চটচটে হয় না।
ত্বক খুব সংবেদনশীল হলে গ্লিসারিন ব্যবহারে অনেক সময় লালচে ভাব, অ্যালার্জি বা অস্বস্তি তৈরি হয়। তবে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পরিমাণ সামান্য। ত্বক সংবেদনশীল কি না, তা সাধারণত আগে থেকে জানা থাকে না আমাদের। তাই গ্লিসারিন ব্যবহারে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এমনিতে সাধারণভাবে বেশির ভাগ মানুষের জন্য এটি নিরাপদ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।