জুমবাংলা ডেস্ক: মো. আব্দুল মান্নান। বয়স ৬৫ বছর। সহায়-সম্বলহীন এক মানুষ। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন শ্রম বিক্রি করে। এতোটা বয়সে এসেও ছুটি মেলেনি তার। স্থানীয় বাজারে ছোট একটি দোকানে বসে খিলি পান বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটি। জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে এলেও কখনো সুযোগ-প্রয়োজন হয়নি লেখাপড়া শেখার। কিন্তু দোকানের হিসাব-নিকাশ তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাইতো প্রবীণ বয়সে ভর্তি হয়েছেন নাতি মাহফুজার রহমানের ছেলে পুতি কাওসার আলীর (৫) সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে।
আব্দুল মান্নান গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নে কাশিয়াবাড়ী গ্রামের মৃত তছিম উদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে তিনি কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বই ও খাতা নিয়ে আব্দুল মান্নান নিয়মিত নাতির ছেলের হাত ধরে বিদ্যালয়ে যান। সেখানে শ্রেণিকক্ষ ভর্তি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখাপড়া শিখছেন তিনি। ক্লাসে তার রোল নম্বর ৩৭।
স্বজনরা জানান, বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে ৬ ভাই ও এক বোনের মধ্যে আব্দুল মান্নান ছিলেন তৃতীয়। সংসারে সবসময় অভাব লেগেই থাকতো। গমের ভাত, প্যারার ছাতু, কাঁঠাল সিদ্ধ খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো তাকে। কখনো পড়ালেখা শেখার সুযোগ পাননি তারা। ছোট বেলা থেকেই বাবার মতো অন্যের বাড়ি-জমিতে কাজ করতেন আব্দুল মান্নান। সারাদিন শ্রম বিক্রি করে মিলত ১ থেকে ২ টাকা অথবা ১ কেজি চাল। এরপর টানা দুই যুগ চালান প্যাডেল চালিত রিকশা-ভ্যান। একপর্যায়ে শরীরে বার্ধক্য বাসা বাঁধে। নিরুপায় হয়ে জীবিকার তাগিদে বাজারে ছোট দোকানে পানের খিলি বিক্রি শুরু করেন তিনি।
আব্দুল মান্নান ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করেন। মালেকা ও জান্নাতী নামে দুই মেয়ে এবং মমিরুল নামে এক ছেলের জনক তিনি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে। ছেলে মমিরুল পলাশবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষা দেবে। বড় মেয়ের ছেলে মাহফুজার বড় হয়ে বিয়ে করেছে। তার ছেলের নাম মো. কাওসার আলী। যে সম্পর্কে আব্দুল মান্নানের নাতি। তারই সঙ্গে একই শ্রেণিতে পড়েন তিনি।
প্রবীণ বয়সে স্কুলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘গ্রামের দোকানে মোট বিক্রির অর্ধেকই হয় বাকিতে। মুখে-মুখে এতো হিসাব বৃদ্ধ বয়সে মনে রাখা সম্ভব হয় না। সেখান থেকেই বাকি লেনদেনের হিসাব লিখে রাখার তীব্র প্রয়োজন অনুভব করি। বাধ্য হয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পেছনে অনেক ঘুরাঘুরি করি। অবশেষে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে বিদ্যালেয়ে যাই। ছুটির পর দোকানে বসে ব্যবসা করি।’
কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান মিথুন মন্ডল বলেন, ‘পেশায় পান দোকানী আব্দুল মান্নান একজন ধার্মিক মানুষ। তিনি বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন থেকে অনুরোধ করে আসছিলেন। তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম শ্রেণিতে তাকে ভর্তি করা হয়। তিনি নতুন বইও পেয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘উনি বই হাতে করে নিয়মিত বিদ্যালয়ে এসে কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে একই শ্রণিতে বসে পড়ালেখা করছেন। উনি আচার-ব্যবহারে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন। উনাকে ক্লাসের সহপাঠিরা পেয়ে আনন্দের সঙ্গে পড়ালেখা করছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান নয়ন বলেন, ‘অনেক দেরিতে হলেও আব্দুল মান্নান পড়ালেখা শেখার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। তিনি যেহেতু শিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, সেটা খুব ভালো কথা। উনি যদি এ বয়সে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজে পড়তে, লিখতে হিসেব রাখতে পারেন তাহলে ওনারই কাজে লাগবে। এটা ওনার অত্যন্ত ভাল একটা উদ্যোগ এবং অন্যদের জন্যও শিক্ষনীয়।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।