আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শ্রীনগরের নামছাবল এলাকায় মির্জা নিসার হুসেইনের তিনতলা বাড়িটায় ঢুকলেই মনে হবে বাড়ির দেওয়ালগুলো যেন মির্জা পরিবারের দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা করুণ কাহিনীর সাক্ষ্য বহন করছে। খবর: বিবিসি বাংলার।
তেইশ বছর আগে দুটি বোমা বিস্ফোরণের মামলায় এ বাড়ির দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার পরে পরিবারটার সঙ্গে যা হয়েছে, সেটাই যেন বাড়িটার দেওয়ালে লেখা রয়েছে।
উনিশ’শ ছিয়ানব্বই সালের কথা। নিসারের বয়স তখন ১৬। নেপাল থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। ভারতের বেশ কয়েকটা শহরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। তেইশ বছর সেই অভিযোগে জেল খাটার পরে বছর খানেক আগে রাজস্থান হাইকোর্ট তাকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে।
নিসার বলেন, আমার আর আমার ভাইয়ের গ্রেপ্তার হওয়া গোটা পরিবারটাকেই ধ্বংস করে দিল।
বিবিসিকে নিসার বলেন, তেইশ-এ মে, ১৯৯৬ সালের ঘটনা। সেই দিনটা সবকিছুই ওলটপালট করে দিল। আমি নেপালে গিয়েছিলাম আমাদের কলোনিরই বাসিন্দা একজনের কাছ থেকে বকেয়া টাকা আনতে। তিনি আমাকে দুদিন অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। আমিও থেকে গিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, পরের দিন আমার সঙ্গে কাজ করত এরকম আরও দুজনের সঙ্গে আমি টেলিফোন বুথের দিকে যাচ্ছিলাম। মহারাজ-গঞ্জ চৌমাথার ওই টেলিফোন বুথে পৌঁছানর আগেই পুলিশ আমাদের ঘিরে ফেলে।
নিসারের কথায়, পুলিশ আমাদের একটা ছবি দেখিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল আমি একে চিনি কি না। আমি এককথাতেই বলেছিলাম, হ্যাঁ। এই লোকটির কাছেই টাকা পাওনা আছে। আমি আগের দিনই টাকা নিতে গিয়েছিলাম তার কাছে। সেখান থেকেই সরাসরি দিল্লির লোদী কলোনিতে নিয়ে আসা হল আমাদের।
অন্ধকার ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ
নিসার আর তার বড় ভাই মির্জা ইফতিয়ার হুসেইনকে দিল্লিতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।
নিসার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে সেখানে দেখি আমার বড় ভাই। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিলাম, তোমাকে কেন গ্রেপ্তার করল?
ইফতিয়ার হুসেইনকে দিল্লির লাজপত নগরে একটা বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ভিড়ে ঠাসা ওই বাজার এলাকায় বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল, আহত হয়েছিলেন ৩৮ জন।
নিসার আর ইফতিয়ারের ওপরে ওই বোমা বিস্ফোরণের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার অভিযোগ ছিল।
নিসার বলেন, আপনি ভাবতেও পারবেন না আমাদের পরিবারের ওপর দিয়ে কী বয়ে গেছে দু দশক ধরে। দু-দুটো মামলা লড়া সহজ ব্যাপার ছিল না। আমাদের সব কিছু তো ওতেই শেষ হয়ে গেছে।
দিল্লির আদালতে ফাঁসির সাজা
দুই মির্জা ভাইদের চার্জশিট দিতেই পুলিশের পাঁচ বছর লেগে গিয়েছিল। জেলে ১৪ বছর কাটানোর পরে ২০১০ সালে দিল্লির এক আদালত নিসার এবং কাশ্মীরের অন্য দুজন বাসিন্দাকে ফাঁসির সাজা দেয়। ইফতিয়ার এবং অন্য চারজনকে মুক্তি দেওয়া হয়।
ইফতিয়ারের কথায়, ২০১০ সালে আমরা ফাঁসির সাজার বিরুদ্ধে আপিল করি। ২০১২ সালে দিল্লি হাইকোর্ট নিসার এবং মুহম্মদ আলি নামের আরেকজনকে ছেড়ে দেয়।
আদালতে ১৬ জন সাক্ষীর প্রত্যেকেই বলেন যে অভিযুক্তদের সঙ্গে ওই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না।
মির্জা ভাইদের হয়ে মামলা লড়েছিলেন নামকরা আইনজীবী কামিনী জয়সওয়াল। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, নিসার এবং বাকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণই দাখিল করতে পারে নি পুলিশ। কোনও প্রমাণ ছাড়াই মামলা করা হয়েছিল।
কামিনী জয়সওয়ালের সঙ্গে ইফতিয়ারের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সংসদ ভবনে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এ আর গিলানি। তাকেও প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিয়েছিল আদালত।
হয়রানির শেষ নেই
দিল্লির বিস্ফোরণের মামলায় মুক্তি পেলেও তাদের হয়রানি শেষ হয়নি।
লাজপত নগর মামলায় মুক্তি পাওয়ার পরে নিসার এবং অন্য পাঁচজনকে রাজস্থানের সমলেটিতে ১৯৯৬ সালের ২৩ মে তারিখে হওয়া এক বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় ১৪ জন মারা গিয়েছিলেন, আহত ৩৭।
ইফতিয়ার বলছিলেন, ওই ঘটনার চার্জশিট দেওয়া হয় ঘটনার ১৪ বছর পরে। মামলা চলে ২০১৪ সাল অবধি। সেবছরই নিম্ন আদালত সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। শুধু কিশোর ফারুক খানকে আদালত মুক্তি দেয়।
রায়ের বিরুদ্ধে রাজস্থান হাইকোর্টে আপিল করলে ২০১৯ সাল অবধি শুনানি চলে। গতবছর ২৩ জুলাই নিসার সহ বাকি সব অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেয়। রায় দিতে গিয়ে আদালত বলেছিল ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ পুলিশ এনেছিল, তার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণই আদালতে পেশ করতে পারেনি তারা।
খবরের কাগজ থেকেই নিসার জানতে পারেন যে রাজস্থান বোমা বিস্ফোরণের মামলায় আদালত তাকে মুক্তি দিয়েছে।
নিসার বলছিলেন, এতগুলো বছর জেলে থাকার সময়ে একটা জিনিসেই একটু মজা পেতাম- খবরের কাগজে যে জোকস আর কার্টুন ছাপা হয়, সেগুলো। ইফতিয়ারকে ২০১০ সালেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ওর ওপরেই দায়িত্ব গিয়ে পড়েছিল আমি সহ বাকিদের ছাড়িয়ে আনার। কাশ্মীরেই ও চাকরি পেয়েছিল, কিন্তু মামলার জন্য বারে বারে দিল্লি যেতে হত, তাই চাকরিটাও চলে যায়।
কাশ্মীরে কারফিউ, তারপর লকডাউন
গত বছর ২৪ জুলাই বাড়ি ফিরেছিলেন নিসার। এক সপ্তাহ পরেই ৩৭০ ধারা বিলোপ করে ভারত শাসিত কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত প্রদেশে রূপান্তরিত করা হয়। অনেক মাস ধরে কারফিউ চলতে থাকে। আবার এবছর মার্চ মাস থেকে করোনা রোধে লকডাউন শুরু হয়।
এক বছরের মধ্যে দু’বার লকডাউনের ফলে ২৩ বছর আগে ফেলে যাওয়া জীবনের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুকরোগুলো এখনও জড়ো করে উঠতে পারেননি।
নিসার বলেন, জেল থেকে বেরনোর পরে আমি ঠিকমতো হাঁটতেও পারতাম না। রাস্তায় চলতেই প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে একটা মোটরসাইকেল সামনে চলে এলে পালিয়ে যেতাম, মনে হত যেন মোটরসাইকেলটা আমাকে চাপা দিয়ে দেবে।
তার মা চাইছেন যে নিসার বিয়ে করে সংসারী হোক। কিন্তু এক বেকার যুবকের পক্ষে সংসার পাতা খুব কঠিন। অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়েছিল নিসার। তারপরেই দিল্লিতে বড়ভাইয়ের কার্পেটের ব্যবসায় সাহায্য করত সে। তাদের বাবারও কাশ্মীরি কার্পেটের ব্যবসা ছিল। বড় ভাই দিল্লিতেও ভালই ব্যবসা গড়ে তুলেছিল।
নিসার বলছিলেন, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে সবাই খুব সহানুভূতি দেখিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সবাই শুধু জিজ্ঞাসা করে এরপরে কী পরিকল্পনা! এই প্রশ্নটাতে আজকাল বিরক্তি লাগে। মনে হয় যেন একটা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আরেকটা জেলে এসে পড়েছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।