প্রতীক ওমর : প্রতি বছর যমুনার ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয় শত শত পরিবার। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এসব মানুষ মাথাগোঁজার ঠাঁই খুঁজে পায় না। কেউ স্বজনদের আশ্রয়ে, আবার কেউ নদীরক্ষা বাঁধে খুপরি ঘর তৈরি করে কোনোরকম রাত কাটায়। এমন অসহায় পরিবারের জন্য সরকার শ্রেণিভেদে ২০-২৫ হাজার এবং ৩০ হাজার টাকা ঘর তৈরির জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। গরিবের সেই টাকাতেও ভাগ বসায় ইউনিয়ন পরিষদ। বরাদ্দপ্রাপ্তদের থেকে অর্ধেক টাকা ঘুষ হিসেবে তোলা হয় আগেই। কিছু মানুষ ঘুষের টাকা অগ্রিম দিতে অপারগ হলে বরাদ্দ আসার পর ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে অর্ধেক কেটে নিয়ে বাকি অর্ধেক টাকা দেয়া হয় তাদের। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকতার দপ্তর সূত্রে জানা যায় চেকগুলো উপকারভোগীদের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাদের নিজ নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাওয়ার কথা। তাদের চেকে অন্য কারও টাকা উত্তোলনের সুযোগ নেই। খবর মানবজমিনের।
অথচ উপকারভোগীদের কেউই তাদের নিজ নামে বরাদ্দকৃত চেক হাতে পায়নি। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে সবার টাকা উত্তোলন করেছে। সেই টাকার অর্ধেক হয়েছে উপকারভোগীদের হাতে। এমন জালিয়াতির খবর মানবজমিনের এই প্রতিবেদকের কাছে আসলে টানা অনুসন্ধান শুরু হয়।
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় নদী এলাকার মানুষের মাঝে কয়েক সপ্তাহের অনুসন্ধান শেষে বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। সাঘাটার ভরতখালী ইউনিয়নের পোড়াগ্রামের বাসিন্দা ফিরোজা বলেন, তাদের ওয়ার্ড মেম্বার নুরুন্নবীর ছেলে আলম মিয়া প্রথমে তাকে বলেন ঘর ভাঙাদের জন্য ৫০ হাজার টাকার বরাদ্দ এসেছে। সেই টাকা পেতে হলে ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হবে। অর্ধেক ভাগ না দিলে কাউকে টাকা দেয়া হবে না। পরে কষ্ট করে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ১৮ হাজার ৯০০ টাকা পেয়েছেন তিনি। একই গ্রামের কছিরন বেওয়া। বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়েছেন। নদীগর্ভে তার থাকার ঘরটিও বিলীন হয়েছে। নুরুননবী মেম্বারের ছেলে আলম মিয়া তার কাছেও অনুদানের টাকা দেয়ার কথা বলে অগ্রিম ১০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে। কছিরন বেওয়া সুদের টাকা নিয়ে ঘুষ দেয় আলমকে। পরে ১৮ হাজার ৯শ’ টাকা হাতে পান কছিরন।
একই ইউনিয়নের কুকরারহাট এলাকার রোজিনা, নবিলা, আবু তালেবসহ বিশেষ বরাদ্দপ্রাপ্ত সবার থেকেই অর্ধেক টাকা ঘুষ হিসেবে নিয়েছে আলম মিয়া। এসব অসহায় মানুষদের নামে বরাদ্দ চেক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আলম নিজেই টাকা উত্তোলন করেন। পরে ইচ্ছেমতো বরাদ্দের অর্ধেক টাকা তাদের হাতে তুলে দেয়। এমন অভিযোগ ভরতখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং মেম্বাররা অস্বীকার করলেও নুরুন্নবী মেম্বার ছেলে আলম মিয়া ঘুষ নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্যও অনুরোধ করেন তিনি। তিনি স্বীকার করে বলেন, পরিষদের পক্ষ থেকেই তাকে ঘুষের টাকা তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। টাকার ভাগ আরও অনেকের পকেটে গেছে। এ বিষয়ে ভরতখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, তালিকাটি তৈরি হয়েছিলো আমি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ২০১৯ সালে। এ বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। তবে কিছু টাকা কম দেয়া হয়েছিলো এমন তথ্য আমার কানে আসলে তাদের টাকা আবার ফেরত দিয়েছে।
তিনি বলেন, কিছু মেম্বার এসব অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। বিশেষ করে নূরুন্নবী মেম্বারের ছেলে আলম বেশি জড়িত ছিল। এদিকে সাঘাটা উপজেলার নদী ভাঙনকবলিত আরেক ইউনিয়ন হচ্ছে হলদিয়া। সেই ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত টাকাও একই কায়দায় দালালদের পকেটে গেছে। এ ইউনিয়নের লনছিয়া গ্রামের বানু সরদার জানান, আমি ২৫ হাজার টাকা পেয়েছি। তার মধ্যে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দেয়া লাগছে। তার নামে বরাদ্দকৃত চেকটিও অন্য কেউ টাকা উত্তোলন করেছে। একই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যাদের নামে ৩০ হাজার টাকা এসেছে তারা ১৭ হাজার, ২৫ হাজার এসেছে তারা ১২ হাজার, ২০ হাজার এসেছে তারা ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন। বাকি টাকা সংরক্ষিত মহিলা মেম্বারের স্বামী আউয়াল আত্মসাৎ করেছেন। স্থানীয় সরকার দলের এক নেতা আব্দুল হাইও টাকা উত্তোলনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে বলেও উল্লেখ করেন ভুক্তভোগীরা।
এসব বিষয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এসব কিছুর মধ্যে নেই। তালিকা অনেক আগের। আমার সময়ের নয়। তিনি বলেন, স্থানীয় কিছু নেতা এসব অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত আছে। এসব বিষয় নিয়ে সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিন মানবজমিনকে বলেন, এ রকম অভিযোগ পেয়েছি। চেক বাবদ কারও সঙ্গে আর্থিক লেনদেন না করার জন্য আগেই বলা হয়েছিলো। কিন্তুনানা কৌশলে একটি সঙ্গবদ্ধ গোষ্ঠী উপকারভোগীদের টাকা কম দিয়েছে। ভুক্তভোগীদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।