রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: তরুণ ফেসবুকারদের কাছে পাওয়া নির্বাচনী রঙ্গ দিয়ে লেখাটা শুরু করি। রঙ্গটা এমন– যখন দেখবেন চেনাজানা নেই, কোটি টাকার গাড়ি থেকে নেমে এসে কেউ আপনার সঙ্গে করমর্দন করছে, বুঝবেন, নির্বাচন এসে গেছে।
ভাগ্যিস, এখনো ভোটারের সঙ্গে অন্তত করমর্দনটা কেউ করছে! সেটাও যদি না করে কী করার আছে?
রঙ্গ হলো, এবার বঙ্গে আসা যাক। বিশেষত উত্তরবঙ্গে। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো উত্তরেও যে এখন ভোটের হাওয়া বইছে, তা নিশ্চয় না বলে দিলেও চলছে। তবে আলাদা করে গাইবান্ধায় এখন ভোটের মধ্যেও কীসের হাওয়া পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই এ কলামে বলতে চাচ্ছি।
উত্তরের এক অবহেলিত জনপদের নাম গাইবান্ধা। এ জেলার লোকজন বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস এশিয়ায়। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া পিছিয়ে পড়া এক অঞ্চল। সেখানকার এক দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ। সেই দেশের মঙ্গাকবলিত এক জনপদ উত্তরবঙ্গ। সেই বঙ্গের সবচেয়ে অবহেলিত জেলা এই মুহূর্তে গাইবান্ধা। কী কপাল! গাইবান্ধা যেন অবহেলারই আরেক নাম।
অথচ গাইবান্ধা হতে পারত উত্তরবঙ্গের অন্যতম সমৃদ্ধ এক জনপদ। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হওয়ায় এ জেলার যেমন রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান। তেমনি পাশের ময়মনসিংহ বিভাগের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কারণেও এর রয়েছে কৌশলগত অবস্থান। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন কি কোথাও আছে? এর বদলে কী দেখছেন এখানকার অধিবাসীরা?
গাইবান্ধার বালাসীঘাট হতে পারে উত্তরাঞ্চলে পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এই বালাসীর চরে স্বয়ং রাত কাটিয়ে গেছেন থাইল্যান্ডের রাজকুমারী। বালাসীঘাট থেকে যমুনার তলদেশ দিয়ে চ্যানেল নির্মাণ এখনো সুদূরের স্বপ্ন। এই চ্যানেল হলে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থায় বলা চলে বিপ্লব ঘটে যাবে। আর কে না জানে, যোগাযোগ কী করে একটা জনপদের চেহারা পালটে দেয়। বর্তমান সরকার দেশকে যে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দেওয়ার সাফল্যের প্রচার করে সে তো দেশব্যাপী যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নেরই গল্প। যমুনার পর পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী চ্যানেল তো রূপকথারই আরেক নাম।
বালাসী চ্যানেল তো দূরের কথা খোদ গাইবান্ধা পৌরসভার রাস্তাঘাটের অবস্থাই তো নাজুক। এখানকার শহরের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সড়কটি যে কখনো মেরামত করতে হবে, সে কথাই তো কর্তাব্যক্তিরা ভুলে গেছেন! না ভুললে এমন একটি সড়ক বছরের পর বছর এমন থাকে কী করে? এই সড়কে শহরের অন্যতম সেরা হাসপাতালগুলোরও অবস্থা। সেই সড়কের এমন অবস্থা হয় কীভাবে?
শহরের দক্ষিণ দিকে রেলওয়ের লেকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া স্টেডিয়াম সড়ক? এই সড়কটি হতে পারে গাইবান্ধাবাসীর বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র। এক পাশে লেকের স্বচ্ছ জল। এর পশ্চিম দিক দিয়ে কু ঝিকঝিক চলে যাচ্ছে ট্রেন। পূবদিক দিয়ে হেঁটে বা যানবাহনে চড়ে যাচ্ছেন আপনি, কী অপূর্ব দৃশ্য! অথচ এই সড়কের আদর্শ কলেজ এলাকা পার হলেই এবড়োখেবড়ো ইটের ভাঙাচোরা রাস্তা! কী পরিহাস, কী পরিদৃষ্ট, কী অদৃষ্ট! দেখে মনে হবে না, এখানে টানা তিন বছর ধরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়ররা ক্ষমতায়। যেন বিমাতাসুলভ বিরোধী দলের কব্জায় এ জেলা!
তাহলে কি ধরে নেব, সরকার কেন্দ্রীয়ভাবেই গাইবান্ধাকে সৎপুত্রের মতো দেখছে। আমাদের তা মনে হয় না। বরং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাজেকর্মে মনে হয়েছে, তিনি কোনো অঞ্চলকেই উন্নয়নবঞ্চিত রাখতে চান না। সন্তানের মতো পুরো দেশই তো তাঁর। তাহলে?
আশার কথা, এতসব অবহেলায়ও গাইবান্ধাবাসী এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষায়। এখানকার বিপুল মেধাবী ছেলেমেয়ে এখন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের পদচারণে, হাসিগানে মুখর হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস। আর চোখেমুখে তাঁদের স্বপ্ন। ওঁদের সঙ্গে কথা বললে কী ভালোই না লাগে!
এই তো সেদিনও স্টেডিয়াম সড়কের লেকপাড়ে কথা হলো কিছু স্বপ্নবাজ তরুণের সঙ্গে। এঁদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেউ চট্টগ্রাম কেউবা দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শীতকালীন অবকাশে বেড়াতে এসেছে। ওঁদের ওখানকার ছাত্রকল্যাণ সমিতিগুলোতে যে গাইবান্ধার ছেলেমেয়েদের সরব উপস্থিতি, তা-ই জানালেন। আর জানাল দুঃখগাথা, কষ্টের কাহিনি, গ্লানির গল্প, খেদের কথা।
তরুণেরা বললেন, দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৬টি। অর্থাৎ প্রতি জেলায় গড়ে একটি করে। এমনকী পাশের কুড়িগ্রাম জেলাও এবার একটি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে। সবাই পাক, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু গাইবান্ধাবাসী কী দোষ করল?
এই তরুণেরা কিন্তু এবারের ভোটার। নতুন ভোটার। অন্যবার কী হয়েছে, তা আমলে নিতে চান না তাঁরা। তাঁরা এবার ভোট দিতে বেজায় উৎসুক। কিন্তু কাকে ভোট দেবে?
তরুণ এই ভোটারদের কথা, গাইবান্ধাবাসী শাহ আব্দুল হামিদকে পেয়েছে, যিনি দেশের জাতীয় সংসদের প্রথম স্পিকার ছিলেন। আবু হোসেন সরকারকে পেয়েছে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। এরশাদের আমলে দু দুজন প্রতিমন্ত্রী পেয়েছে একইসঙ্গে। হালে সংসদে ডেপুটি স্পিকার, হুইপও পেয়েছে। কিন্তু তাঁরা গাইবান্ধাবাসীর জন্য কতটুকু করেছেন? তাঁদের সামর্থ্যের সেরাটা দিয়েছেন কী?
অবশ্য তরুণেরা হাল ছাড়তে জানেন না। তাঁরা আশাও ছাড়ছেন না। তাঁদের কথা, গাইবান্ধায় সবার আগে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হোক। এখান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বের হোক স্বপ্নবাজ তরুণ। বাকি সমস্যা তাঁরা নিজেরাই সমাধান করে নেবেন ইনশাল্লাহ।
প্রতিবার ভোটের সময় একটা জনপ্রিয় স্লোগান শুনতে পাই। সেটা হলো– ভোটা চাই ভোটারের, দোয়া চাই সকলের। এবারও সেটা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ভোটাররা কী চান, সেটা কি এ দেশের কোটি টাকার গাড়ি চড়া প্রার্থীরা শুনতে পান? গাড়ি থেকে নেমে করমর্দন শেষে জানতে চান?
বিশেষত গাইবান্ধার তরুণ ভোটারদের চাওয়া কী, কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন?
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।