জুমবাংলা ডেস্ক: ধান দানাশস্য জাতীয় উদ্ভিদ। ধানের প্রতিটি অংশ কৃষকদের জীবনে কাজে লাগে। এরমধ্যে অন্যতম উপজাত হলো খড়। গরুর খাদ্য ছাড়াও জ্বালানি, কাঁচা ঘরের ছই তৈরি, বীজ জাগ দেওয়াসহ নানা কাজে কৃষকরা খড় ব্যবহার করেন। খড়ের সর্বাধিক ও বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য খড়ের দড়ি প্রস্তুত করার পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা।
ব্রি কর্তৃক ‘যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ)’ প্রকল্পের অর্থায়নে সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে ‘ব্রি স্ট্র রোপ মেকার’ বা ‘দড়ি পাকানো যন্ত্র’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। যন্ত্রটি দিয়ে অতি সহজে, কম শ্রমে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাসের দড়ি প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।
যন্ত্রটি তৈরির উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলে এসএফএমআরএ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘খড় দিয়ে কম সময় দড়ি তৈরি করা, দড়ির ব্যাস সমান রেখে বিভিন্ন ব্যাসের দড়ি তৈরি, খড়কে দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণ এবং এই দড়ি তৈরি কেন্দ্রিক ব্যবসা সৃষ্টি ও গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরি করা। এ মেশিন দিয়ে মিনিটে ৩ মিটার লম্বা দড়ি তৈরি করা যায় এবং খড় দিয়ে তৈরি দড়ি এক মণের অধিক লোড নিতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অটোক্যাড ইঞ্জিনিয়ারিং টুলস (সফটওয়্যার) এর সাহায্যে তৈরি দড়ি পাকানো যন্ত্রটির নকশা তৈরি করা হয়। নকশা অনুযায়ী ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের গবেষণা ওয়ার্কশপে যন্ত্রটির প্রথম প্রটোটাইপ তৈরি করা হয়। যন্ত্রটির মটরের ক্ষমতা ০.৫৬ কিলোওয়াট যা দিয়ে প্রতি মিনিটে ৩ মিটার দড়ি তৈরি করা যায়।’
‘ব্রি স্ট্র রোপ মেকার’ কিভাবে কাজ করে জানতে চাইলে ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, অতি সহজভাবে বলতে গেলে, যন্ত্রটি সমতল জায়গায় স্থাপন করে মোটরে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিতে হবে। মোটর থেকে শক্তি রোলিং ফ্রেম বার এবং স্ট্র রোলিং ফ্রেম হয়ে বিভেল গিয়ারে ও উল বাস্কেটে পৌঁছায়। একই সময়ে দুটি স্ট্র ইনার ফানেলে খড় প্রবেশ করাতে হবে। স্ট্র রোলিং ফ্রেম ঘুরে দড়িকে পাকানোর জন্য দুটি ভাগে ভাগ করে দেয়। প্রথম ভাগে মূল বেইজের ডানে এবং বামের স্ট্র ইনার ফানেলের ওপর পরিমাণ অনুযায়ী স্ট্র ফানেলের ভেতর ডিভাইডারের মাঝে রেখে দিলে প্রন ও স্রিম্প এর ভিতরের দুইটি স্ট্র ইনার হুইল উল বাস্কেটের মাধ্যমে ঘুরে দড়ি তৈরি হতে থাকে। তৈরি হতে থাকা দড়ি দ্বিতীয় ভাগের স্ট্র রোলার চাপ দিয়ে ধরে স্ট্র লাইন স্ট্যান্ডের উপর দিয়ে রিল কোরে পৌঁছে দিয়ে রিল ঘুরে দড়ি তৈরির কাজ সম্পন্ন করে। রিল কোর দড়িতে পূর্ণ হলে মোটরের বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করতে হবে। রিল সাইডের নাট খুলে রিল কোর থেকে দড়ি বের করতে হয়।
পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেমটি মোটর থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি পুলি ঘুরানোর মাধ্যমে রোলিং ফ্রেম বার এবং স্ট্র রোলিং ফ্রেম ঘুরে বিভেল গিয়ার এ্যাডজাস্ট ফ্রেমে বেয়ারিং কভারের চাপে শ্যাফটের ভেতর স্ট্রেইট বিভেল গিয়ারের সাহায্য বিপরীতমুখি স্ট্রেইট বিভেল গিয়ারটি নিজে ঘুরে। রোলিং ফ্রেম বারের শ্যাফটের সঙ্গে সংযুক্ত স্পার গিয়ারগুলিকে ঘুরিয়ে দড়ি পাকাতে সাহায্য করে। দড়ি পাকানোর জন্য রোলিং ফ্রেম বার এবং স্ট্র রোলিং ফ্রেম ঘূর্ণায়মান শক্তিকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেয়। প্রথম ভাগ মোটর থেকে পুলি ও পুলি থেকে রোলিং ফ্রেম বার এবং স্ট্র রোলিং ফ্রেম পাওয়ার নিয়ে নিজে ঘুরে ও একই সঙ্গে রোলিং ফ্রেমের ফিক্স সেল্ভ ঘুরায়। ফিক্সড সেল্ভ নিজে ঘুরে উল বাস্কেটকে ঘুরায়। দড়ি তৈরির জন্য উল বাস্কেট নিজে ঘুরে বিভেল গিয়ার এ্যাডজাস্ট ফ্রেমের প্রন ও স্রীম্প এর ২টি স্ট্র ইনার হুইল (বেভেল গিয়ার) এবং ২টি ফানেলকে একটি অপরটির বিপরীত দিকে ঘুরাতে থাকে। দ্বিতীয় ভাগে মোটর থেকে পাওয়ার পুলি, রোলিং ফ্রেম বার এবং স্ট্র রোলিং ফ্রেম ঘুরে বিভেল গিয়ার এ্যাডজাস্ট ফ্রেমে বেয়ারিং কভারের চাপে শ্যাফটের স্ট্রেইট বিভেল গিয়ারের সাহায্য নিয়ে রোলিং ফ্রেম বারের শ্যাফটের স্পারকে ঘুরায়। স্পার গিয়ার ঘুরে শ্যাফটের ২ নম্বর ও ৩ নম্বর স্পার গিয়ার এবং স্ট্র রোলারকে ঘুরায়। স্ট্র রোলার ঘুরে স্ট্র রোলার শ্যাফটের বিপরীত পাশের ৪ নম্বর স্পার গিয়ারকে ঘুরায়। ৪ নম্বর স্পার গিয়ার ঘুরে শ্যাফটের ৫ নম্বর স্পার গিয়ারকে ঘুরায়। ৫ নম্বর স্পার গিয়ার ঘুরে শ্যাফটের টেনশন গিয়ারকে ঘুরায় এবং টেনশন গিয়ার ঘুরে চাপ দিয়ে ধরে রিল ও রিল কোরকে ঘুরিয়ে দড়ি তৈরীর কাজ করে।
তবে যন্ত্রটি ব্যবহারে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন- যন্ত্রটি চালানোর পূর্বে ধানের খড়ের আর্দ্রতার পরিমাণ অবশ্যই ১২ শতাংশের বেশি থাকতে হবে। খড়ের আর্দ্রতা কম হলে উন্নত মানের দড়ি পাওয়া যাবে না। উভয় পাশের স্ট্র ইনার ফানেলে সমভাবে সমপরিমাণ খড় দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো ক্রমেই খড়ের পরিমাণ কম-বেশি না হয়। যন্ত্রটি চালানোর আগে মোটর বেজ, বেল্ট টেনশন, অ্যালাইন্টমেন্ট, সকল ধরনের নাট, বোল্ট ও অন্যান্য ঘূর্ণায়মান অংশগুলো ভালোভাবে চেক করে নিতে হবে। দক্ষ চালক দ্বারা যন্ত্রটি চালনা করতে হবে। যন্ত্রটি ব্যবহারের পর মোটরের পাওয়ার অফ করে ভি-বেল্ট পুলি খুলে রাখতে হবে। ঘূর্ণায়মান অংশে অয়েল-গ্রিজ দিতে হবে। কোনো পার্টস ভেঙ্গে গেলে বা নষ্ট হলে, বিয়ারিংয়ে অযাচিত শব্দ হলে অথবা গিয়ারের দাঁত ক্ষয়প্রাপ্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করতে হবে। যন্ত্রটি কোনো অবস্থায় বাড়ির আঙ্গিনায়, উঠানে বা খোলামেলা স্থানে রাখা যাবে না। যন্ত্রটি ব্যবহারের পর ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটেট সিনিয়র লিয়াজোঁ অফিসার কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন বলেন, ধান একটি বহুমাত্রিক শস্য। যার প্রতিটি অংশই কৃষকের কাজে লাগে। এরমধ্যে খড় হল ধানের একটি প্রধান উপজাত। খড়-কুটো বলে একে তুচ্ছজ্ঞান করার জো নেই। কারণ এর প্রয়োজনের কোনো কমতি নেই। ধানের মৌসুমে গ্রামগঞ্জের কৃষক বাড়ি বা রাস্তাঘাটে স্তূপাকারে রাখা এই খড় যে কতো কাজে লাগে তা কৃষকই ভালো জানেন। ধানের খড় স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য এবং পরিবেশ-বান্ধব। ধানের খড়ের দড়ি আধুনিক দড়ি হিসেবে বিবেচিত বিধায় কৃষক যন্ত্রটি ব্যবহার করে কম সময়ে, স্বল্প শ্রমে, দ্রুত এবং উন্নত মানের দড়ি তৈরি করতে পারবেন। খড়ের দড়ি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে কৃষকরা লাভবান হবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।