ফ্রান্সের গর্বের লুভ্র জাদুঘরে চুরির ঘটনায় সারা পৃথিবী জুড়ে পড়ে শুরু হয়েছে হইচই। সংগ্রহশালাটি থেকে কিংবদন্তি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এবং তাঁর স্ত্রীর অলঙ্কার হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে দুষ্কৃতীর দল। তবে এ বারই প্রথম নয়। লুভ্রে চুরির ঘটনা ঘটেছে বহু
প্যারিসের ঐতিহ্যবাহী লুভ্র জাদুঘরে দুঃসাহসিক চুরির ঘটনায় দুনিয়া জুড়ে শোরগোল। খোয়া গিয়েছে কিংবদন্তি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের গয়না। নিরাপত্তার ঘোরাটোপ গলে কোন রাস্তায় জাদুঘরের গ্যালারিতে ঢোকে দুষ্কৃতীর দল? বিভিন্ন সামগ্রী হাতিয়ে নিয়ে কী ভাবেই বা রক্ষীদের চোখের সামনে দিয়ে চম্পট দিল তারা? ঘটনার জেরে হন্যে হয়ে এ সব প্রশ্নের জবাব খুঁজছে স্থানীয় গোয়েন্দা ও পুলিশ। তবে চোরেদের হানা বা ঐতিহাসিক সামগ্রী লুঠ— লুভ্রের ইতিহাসে কোনও কিছুই নতুন নয়।
শ্যেন নদীর তীরে ফ্রান্সের রাজধানী শহরে ঘুরতে আসা সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে মূল আকর্ষণ দু’টি। একটির নাম আইফেল টাওয়ার। আর দ্বিতীয়টি হল, লুভ্র জাদুঘর। সেখানে পরম যত্নে সংরক্ষিত আছে ইটালীয় রেনেসাঁ যুগের জগদ্বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা তৈলচিত্র ‘মোনা লিসা’। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও এক বার সেই ছবি হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছিল চোর। পরবর্তী দু’বছর তার জিম্মাতেই ছিল ‘মোনা লিসা’। শেষে অবশ্য দ্য ভিঞ্চির চিত্রকলাকে উদ্ধার করে লুভ্রে ফিরিয়ে আনেন ফরাসি গোয়েন্দারা।
লুভ্র থেকে ‘মোনা লিসা’ চুরির ঘটনাটি ঘটে ১৯১১ সালের ২১ অগস্ট। প্যারিস থেকে দ্য ভিঞ্চির চিত্রকলা সরিয়ে ফেলার মূল চক্রী ছিলেন ইটালির কারিগর ভিনসেঞ্জো পেরুগিয়া। জাদুঘরের কর্মীর ছদ্মবেশ নিয়ে লুভ্রে ঢোকেন তিনি। রাতভর সেখানেই লুকিয়ে ছিলেন ভিনসেঞ্জো। পরের দিন ফাঁক বুঝে ছবিটা হাতিয়ে নিয়ে জাদুঘর থেকে বেরিয়ে যান। কর্মীর ছদ্মবেশ থাকায় কেউ তাঁকে সন্দেহ করেননি। পরীক্ষা করা হয়নি পেরুগিয়ার ব্যাগটিও।
লুভ্র থেকে যে ‘মোনা লিসা’ চুরি গিয়েছে, সেটা বুঝতেই জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কয়েক ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। শেষে তাদের করা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামে ফরাসি পুলিশ। তত ক্ষণে অবশ্য অভিযুক্ত ভিনসেঞ্জো নাগালের বাইরে চলে গিয়েছেন। ১৯১৩ সালে ইটালির ফ্লোরেন্স শহরে দ্য ভিঞ্চির শিল্পকর্মটি বিক্রি করার চেষ্টা করতে গেলে ধরা পড়ে যান পেরুগিয়া। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। উদ্ধার হওয়া ‘মোনা লিসা’ দু’বছর পর ফিরে আসে লুভ্রের সুনির্দিষ্ট গ্যালারিতে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ইটালীয় রেনেসাঁ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই চিত্রকলাটির সঙ্গে ফ্লোরেন্স শহরের আত্মার যোগ রয়েছে। ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে দ্য ভিঞ্চি এই তৈলচিত্রটি এঁকেছিলেন বলে মনে করা হয়। যে ইটালীয় অভিজাত তরুণীকে তিনি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন, তাঁর নাম ছিল লিসা দেল জোকোন্দো। ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত গেরার্দিনি পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। ৪০০ বছর পর ঠিক সেখান থেকেই চুরি যাওয়া ‘মোনা লিসা’কে উদ্ধার করেন তদন্তকারীরা।
লুভ্রের গ্যালারিতে এ-হেন তৈলচিত্রটিকে নষ্ট করার চেষ্টাও নেহাত কম হয়নি। ১৯৫৬ সালে এক পর্যটক ব্লেড দিয়ে ছবিটাকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। ওই বছরই দ্য ভিঞ্চির শিল্পকর্মে পাথর ছোড়েন এক বলিভিয়াবাসী। ১৯৭৪ সালে জাপানের রাজধানী টোকিয়োর একটি প্রদর্শনীতে ‘মোনা লিসা’কে পাঠিয়ে দেয় ফরাসি সরকার। সেখানে ছবিটির কাচের ঘেরাটোপের উপর রঙিন স্প্রে করে দেন এক পর্যটক। তবে এগুলির কোনওটিই ওই ঐতিহাসিক শিল্পকর্মটিকে নষ্ট করতে পারেনি।
২০০৯ সালে ‘মোনা লিসা’র বুলেটপ্রুফ কাচে চায়ের কাপ ছুড়ে মারেন এক রুশ মহিলা। ফ্রান্সের নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করেছিলেন তিনি। কিন্তু, সেটা প্রত্যাখান করে সরকার। সেই রাগ দ্য ভিঞ্চির শিল্পকর্মের উপরে দেখাতে গিয়ে গ্রেফতার হন ওই রুশ মহিলা। ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিবাদ করতে তৈলচিত্রটির উপর কেক ছিটিয়ে দেয় এক বিক্ষোভকারী। ‘মোনা লিসা’র উপর সর্বশেষ আক্রমণটি হয় ২০২৪ সালে। গত বছর পরিবেশবিদেরা দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টিটিকে ঘিরে রাখা বুলেটপ্রুফ কাচে স্যুপ ছিটিয়ে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৩৯-’৪৫ সাল) মাত্র ছ’সপ্তাহে জার্মান ফ্যুয়েরার অ্যাডল্ফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে পতন হয় ফ্রান্সের। প্যারিসে ঢুকেই তাঁদের প্রথম নজর গিয়ে পড়ে লুভ্রের উপর। সেখানে থেকে কিছু শিল্পকর্ম বার্লিনে নিয়ে গিয়েছিল নাৎসিরা। বিষয়টি আঁচ করে আগেভাগেই বেশ কিছু ঐতিহাসিক সামগ্রী লুকিয়ে ফেলেন লুভ্র কর্তৃপক্ষ। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ওই জাদুঘর থেকে লুট করে আনা প্রায় সমস্ত সামগ্রীই ফরাসিদের ফিরিয়ে দিয়েছিল জার্মান সরকার।
১৯ শতকে ফরাসি শিল্পকলায় বাস্তববাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বিখ্যাত চিত্রশিল্প জিন ডেসিরে গুস্তাভ কোরবেট। তাঁর আঁকা ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘দ্য ওয়েভ’। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তা লুভ্রের গ্যালারিতে শোভা পেয়েছে। স্থানীয় পুলিশের দাবি, ওই বছর সংশ্লিষ্ট শিল্পকীর্তিটিকে চুরি করে একদল পেশাদার চোর। কোরবেটের আঁকা ওই ছবি আজও উদ্ধার করা যায়নি। চিত্রকর্মটি গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিও রহস্যে মোড়া।
এ ছাড়া লুভ্র থেকে গায়েব হয়েছে ১৮ শতকের ফরাসি চিত্রশিল্পী জিন সিমিওন চার্ডিনের আঁকা একটি তৈলচিত্র। ১৯৮৩ সালে প্যারিসের ওই জাদুঘর থেকে ১৯ শতকের ফরাসি রোমান্টিক চিত্রশিল্পী ইউজ়িন ডেলাক্রোইক্সের আঁকা ‘লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ নিয়ে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করে একদল দুষ্কৃতী। ছবিটিতে ১৮৩০ সালের ফরাসি বিপ্লব ফুটিয়ে তোলেন তিনি। সে বার অবশ্য চোরাই মাল নিয়ে লুভ্র থেকে বেরোতে পারেনি চোরের দল। বমাল তাদের গ্রেফতার করেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
১৯৮৩ সালে লুভ্র থেকে গায়েব হয়ে যায় রেনেসাঁ যুগের একটি বর্ম। এর ছিল দু’টি অংশ— নকশাকাটা মেলানিজ় হেলমেট এবং ব্রেস্টপ্লেট। ১৯২২ সালে সংশ্লিষ্ট বর্মটি লুভ্র কর্তৃপক্ষকে দান করেন বিখ্যাত রথসচাইল্ড পরিবার। প্রায় ৪০ বছর পর ২০২১ সালে এক সামরিক বিশেষজ্ঞের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট সামগ্রীগুলিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
১৯৭৬ সালে লুভ্রে ঢুকে রাজা চার্লস এক্সের একটি হিরাখচিত তরবারি চুরি করে তিন দুষ্কৃতী। ১৯৯০ সালে আবার সংগ্রহশালাটির গ্যালারি থেকে গায়েব হয়ে যায় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পিয়ের-অগস্ট রেনোয়ারের একটি পোর্টেট, যাতে বসে থাকা এক মহিলার প্রতিকৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। ফ্রেম কেটে সংশ্লিষ্ট ছবিটি নিয়ে পালায় চোরের দল।
বার বার চোরদের ‘নেকনজরে’ পড়া এ-হেন লুভ্রের জাদুঘর হয়ে ওঠার গল্পটাও ভারী চমৎকার। ১২-১৩ শতকের মধ্যে এটি ছিল একটি দুর্গ। ১৫৪৬ সালে ফরাসি রাজা প্রথম ফ্রঁসোয়া একে তাঁর মূল রাজপ্রাসাদ হিসাবে গড়ে তোলেন। পরবর্তী রাজারাও থাকতেন লুভ্রেই। ১৬৮২ সালে ষোড়শ লুই ওই বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে চলে যান ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদে। ফলে রাজকীয় সামগ্রীর একটি প্রদর্শনী হিসাবে গড়ে ওঠে লুভ্র। ১৭৯৩ সালে একে জাদুঘরের রূপান্তরিত করা হয়।
প্রায় আট লক্ষ বর্গফুটের লুভ্রে রয়েছে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার দ্রষ্টব্য। এর মধ্যে প্রদর্শিত হয় অন্তত ৩৫ হাজার শিল্পকর্ম ও সামগ্রী। বর্তমানে সংগ্রহশালাটির মোট আটটি বিভাগ রয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শিল্পকলা প্রদর্শিত জাদুঘর। প্রতি বছর সংগ্রহশালাটিতে ঘুরতে আসেন প্রায় সা়ড়ে ৯ কোটি পর্যটক।
ফরাসি সংবাদসংস্থা ‘এএফপি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ৯টা ৪০ মিনিটের মধ্যে লুভ্রে ঢুকে ‘ডাকাতি’ করে দুষ্কৃতীর দল। সম্রাট নেপোলিয়ন এবং তাঁর স্ত্রী জোসেফিন দ্য বোয়ারনের বেশ কিছু গয়না নিয়ে চম্পট দেয় তারা। ১৮০৪ সালে সম্রাট হিসাবে তাঁর অভিষেকের পর ওই অলঙ্কারগুলি তৈরি করানো হয়েছিল।
প্রাথমিক তদন্তে ফরাসি পুলিশ জানিয়েছে, লুভ্র জাদুঘর থেকে মোট ন’টি গয়না খোয়া গিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বহুমূল্য নেকলেস এবং ব্রোচ। ১৮৩০ সালের দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লবের সময় সংশ্লিষ্ট অলঙ্কারগুলির বেশ কয়েকটা চুরি গিয়েছিল। পরে অবশ্য সেগুলি উদ্ধার করে প্রশাসন। এ বারের ঘটনা নিয়ে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী লরা নুনিয়া জানিয়েছেন, সাত মিনিটেরও কম সময়ে গোটা অপারেশন শেষ করে দুষ্কৃতীরা।
তদন্তকারীদের অনুমান, সুপরিকল্পিত ভাবেই নেপোলিয়নের গয়না লুট করেছে চোরের দল। ঘটনায় তিন থেকে চার জনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর জন্য অ্যাপোলো গ্যালারি (গ্যালারে ডি’অ্যাপোলন) রেকিও করে তারা। স্থানীয় গণমাধ্যম ‘লা প্যারিসিয়েন’কে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী লরা বলেন, ‘‘চেরি পিকারের (এক ধরনের হাইড্রলিক ল্যাডার) সাহায্যে জাদুঘরে ঢোকে দুষ্কৃতীর দল।’’ চুরি করতে ডিস্ক কাটার (গাছ বা কাঠ কাটার যন্ত্র) ব্যবহার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।