সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: রাজনীতির অর্জন-অনার্জন-বিসর্জন এসব বিষয় প্রাসঙ্গিক কারণেই ফিরে ফিরে আলোচনায় আসে। স্বাধীন বাংলাদেশে তো বটেই, স্বাধীনতা-পূর্ব কিংবা এরও আগে আমাদের এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনীতিকেন্দ্রিক নানা রকম কূটকৌশল কিংবা সুবিধা-ফায়দালাভের বিষয় আলোচনা-পর্যালোচনায় বিভিন্নভাবেই এসেছে। এ থেকে আমাদের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে তা প্রীতিকর নয়। রাজনীতিতে গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোঁড় সংগঠন এখন সংগতই আলোচনার বাড়তি খোরাক জোগায়। রাজনীতির যে সংজ্ঞা-সূত্র; এর সঙ্গে এসব বিষয় স্পষ্টত সাংঘর্ষিক; একই সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত।
যে কোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজের কল্যাণে রাজনীতি অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয়- এ নিয়ে বিতর্ক থাকার কথা নয়। রাজনীতিবিহীন কোনো সমাজেই মানুষের অধিকারের পূর্ণতা তো বটেই, নূ্যনতম স্বার্থরক্ষাও কঠিন। কিন্তু প্রশ্ন- কোন রাজনীতি আবশ্যক? অবশ্যই সুস্থ ধারার রাজনীতি। দায়বদ্ধ রাজনীতি। স্বচ্ছ রাজনীতি। স্বাধীন বাংলাদেশ তো বটেই, আমাদের আরও অনেক কিছুর অর্জনই ঘটেছে রাজনীতির কল্যাণে, রাজনীতির মাধ্যমে; রাজনীতির সংজ্ঞা-সূত্রের রীতিনীতি মেনে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজনীতির এই পথটা আমাদের সামনে মসৃণ কিংবা কুসুমাস্তীর্ণ থাকেনি। হীনস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি পথ হারিয়েছে। আর এর মাশুল গুনতে হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষকে।
রাজনীতি পথহারা হওয়ায় এবং কখনও কখনও রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতছাড়া হওয়ার কারণেই রাজনীতিকেন্দ্রিক বহুবিধ উপসর্গ সমাজদেহ বিষিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি সমকালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনীতিতে নতুন আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে ভুঁইফোঁড় সংগঠন। আরও বলা হয়েছে, শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করেই গড়ে উঠেছে প্রায় একশ সংগঠন। এসব সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা তদবির-চাঁদাবাজিসহ নানারকম দুস্কর্মে লিপ্ত। এ অভিযোগ নতুন নয়। অতীতে অন্য রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলেও কমবেশি এমনটি দেখা গেছে। নিঃসন্দেহে এ এক গুরুতর ব্যাধি এবং এ ব্যাধির বিস্তার ক্রমেই বাড়ছে; ভবিষ্যৎ হচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। রাজনীতির এই দুরবস্থার দায় অবশ্যই রাজনীতিকরা এড়াতে পারেন না। একই সঙ্গে এও সত্য, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনিষ্ঠ নীতিনির্ধারকরা আশু এ ব্যাপারে সজাগ না হলে আদর্শিক রাজনীতির অবশিষ্টাংশও তলিয়ে যাবে অস্বচ্ছতার কাদাজলে।
আমাদের দেশে দুর্নীতি বহু পুরোনো ব্যাধি। তবে আমরাই একমাত্র দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বা জাতি নই। দুর্নীতিবিষয়ক গবেষণায় প্রায় প্রতি বছরই এর ভিন্ন ভিন্ন চিত্র আমরা পাই। স্বাধীনতা-উত্তর তো বটেই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের ব্যাপক অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত। কিন্তু দুর্নীতি নামক সর্বগ্রাসী ব্যাধি নির্মূল সম্ভব হচ্ছে না। উপরন্তু কখনও কখনও এর চিত্র এতটাই উৎকট লক্ষ্য করা যায়, যা বিস্ময়কর। চলমান করোনা দুর্যোগকালেও দেখা ও জানা গেছে অবিশ্বাস্য যত কাণ্ডকীর্তি!
রাজনীতির খতিয়ানে নাম লেখানো, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাবান অনেকেরই দল পরিবর্তনের ঔৎসুক্য কিংবা হীন প্রতিযোগিতা এমনকি নির্বাচনে দলীয় টিকিট লাভের আশায় ‘ইঁদুর দৌড়’ কিংবা কখনও কখনও এ নিয়ে ‘বাণিজ্য’ আমাদের অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাতের শামিল। রাজনীতির নামে এ অপতৎপরতা রাজনীতির চরিত্র হরণ করছে। আমরা ইতিহাসে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আমাদের অবীরোচিত কাজগুলোর হোতারা তো নিন্দিত কিংবা পরিতাজ্য নন। বরং তাদের কেউ কেউ নানাভাবে ‘দেশসেবা’, ‘জাতিসেবা’র অগ্রদূত সেজে কত রকম কসরতই করেছেন! করছেন নিজেদের হিসাবের লাভালাভের সমীকরণ কষে। রাজনীতি তাদের কাছে বড় ‘বাণিজ্য’ক্ষেত্র। তরতর করে জৌলুস বাড়ানোর বড় অবলম্বন।
খুব বিস্ময় লাগে- গণতন্ত্রের নামে, গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে, দেশ-জাতির কল্যাণের নামে তারা অনেক ক্ষেত্রে দলের ওপরের স্তরের নীতিনির্ধারকদের ‘ম্যানেজ’ করে ক্রমাগত যে কদর্যতা সৃষ্টি করছেন; এর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরুদ্বিগ্ন থাকার মোটেও উপায় নেই। রাজনীতি তাদের কাছে বড় বিনিয়োগ ক্ষেত্র। এ বিনিয়োগ যে শুধু অর্থনির্ভর, তাও নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরও অনেক কিছু এবং স্বার্থান্বেষীরা রাজনীতির নামে অপরাজনীতির খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আদর্শিক রাজনীতির পুনরুজ্জীবনের স্বার্থে; দেশ ও জাতির বৃহৎ কল্যাণের প্রয়োজনে রাজনীতির গুণগত মান উন্নয়নের কোনোই বিকল্প নেই। কারা করবেন এ কাজটা? নিশ্চয় রাজনীতিকরাই করবেন? তাদেরই করতে হবে। রাজনীতির নামে শুধু অপরাজনীতিই নয়; অরাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ডের পথ রুদ্ধ করতে হবে। যারা এমন দুস্কর্মে লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। হীনস্বার্থবাদীরা রাজনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘খুঁটির জোরে’। এই খুঁটি অস্পর্শিত রেখে যে কোনো সুফলের আশা দুরাশারই নামান্তর। যে জনযুদ্ধের মাধ্যমে বিপুল ত্যাগে এ দেশের অভ্যুদয়; এর পেছনে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু অঙ্গীকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা লালনেরও বিচ্যুতি ঘটেছে অনেক ক্ষেত্রে। আর এর অপচ্ছায়া পড়েছে রাজনীতিতে এবং মানুষের কল্যাণের পথটা হয়েছে কণ্টকাকীর্ণ।
খুব কম কথায় আমাদের এই ক্ষয়ের অধ্যায় বিশদভাবে তুলে ধরা দুরূহ। তবে একটা আশার ব্যাপার হলো এই, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, তাদের অচেতন করে রাখার প্রয়াস সত্ত্বেও। মানুষ অনেক কিছুই বোঝে বটে, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই তারা অসহায়। তারা অসহায় ব্যবস্থার কাছে। ব্যবস্থা যেখানে খারাপ; অবস্থা সেখানে ভালো হয় কী করে? গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ নির্বাচন। এই নির্বাচন ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক কত অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে! অনিয়মের হোতারা, ব্যবস্থা ধ্বংসের খলনায়করা রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের কাছে মূল্যায়িত হচ্ছেন তাদের স্বার্থ ও প্রয়োজনে। রাজনীতির রূপ বদলাতে হবে। হূতগৌরব পুনরুদ্ধার করতেই হবে। ব্যক্তি কিংবা মহলবিশেষের কাছে এভাবে তো বৃহৎ জনগোষ্ঠেীর স্বার্থ, দেশের কল্যাণ বিসর্জিত হতে পারে না। দলে যদি গণতন্ত্র চর্চা, স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত পুষ্ট করা না যায়, তাহলে দেশ কিংবা সমাজ আলো ছড়াবে কীভাবে? রাজনীতির দোষত্রুটি, ব্যর্থতা সবই দূর করতে হবে রাজনীতি দিয়েই। ভুঁইফোঁড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আওয়ামী লীগের তরফে শোনা গেছে। এই বোধোদয়ের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু রাজনীতির অস্বচ্ছতা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয় কিংবা থেমে নেই- নীতিনির্ধারকরা যেন এ কথাটাও মনে রাখেন। নেতিবাচকতার ছায়া অনেক বিস্তৃত এবং এর কারণটাও নিশ্চয় তাদের অজানা নয়। ব্যাধি যেহেতু গুরুতর, তাই টোটকা দাওয়াইয়ে কাজ হবে না। শুভবোধের প্রত্যয়ে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে অনেক, কিন্তু কাজের কাজ কি সেভাবে হয়েছে- এ প্রশ্নের উত্তরটা নিশ্চয় তাদের ভালো জানা আছে।
দলের নীতিনির্ধারকদের সুযোগসন্ধানী কিংবা হীনস্বার্থবাদীদের নিয়ন্ত্রণ কেন কঠিন হয়ে পড়েছে; এর কারণ তাদেরই ভালো জানার কথা। কেন রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে; তাও তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর শোনা গিয়েছিল, সর্বত্র চলবে শুদ্ধি অভিযান। সুযোগসন্ধানী-সুবিধাভোগী-দুস্কর্মকারী যারা দলের নাম ভাঙিয়ে কিংবা দলের শাখা-উপশাখা কিংবা সংগঠন গড়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন, গোচ্ছাচ্ছেন; তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু কাজটা কি সেভাবে হয়েছে? কেন হয়নি- এই প্রশ্নগুলোর নিরিখে প্রতিকারে নিষ্ঠ হয়ে অনাচার-দুরাচার-অন্ধকারের বিস্তার ঠেকাতে হবে। এ জন্য জরুরি দীর্ঘ পরিকল্পনা, নির্মোহ অবস্থান। রাজনীতির ব্যাধি থেকেই সৃষ্ট দুর্নীতি নামক ব্যাধিরও। কাজেই ব্যবস্থা প্রয়োজন বহুমাত্রিক।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।