তসলিমা নাসরিন : আমার আত্মীয়রা বাংলাদেশের লাল সবুজ জামা পরে নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গিয়েছিল বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা দেখতে। প্রথম থেকেই জেতার উত্তেজনায় চিৎকার করেছে। কিন্তু বড় হতাশ হয়ে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়েছে। শেষ ওভারের আগ পর্যন্ত তারা ধরেই নিয়েছিল বাংলাদেশ জিতবে। প্রায় জিতে যাওয়া খেলা বাংলাদেশ হেরেছে। মাত্র চার রানে হেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। ঠিক যেমন করে আগের দিন পাকিস্তান হেরেছে ভারতের কাছে। বাংলাদেশের এমন পরাজয়ে ক্ষুব্ধ ক্রিকেটপ্রেমী জনতা।
সাকিবের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ খুব বেশি। তারা বলছে, ‘ফুল টাইম এমপিগিরি আর পার্ট টাইম ক্রিকেটগিরি দিয়ে কি ওয়ার্ল্ড কাপ হয়? গাছেরটাও খাবে তলারটাও কুড়াবে!’ বলছে, ‘সে না পারে ব্যাটিং, না পারে বোলিং, সাকিব, হয় আপনি বারবিকিউ পার্টি ছাড়ুন, নতুবা ক্রিকেট ছাড়ুন।’ ‘তুই না বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার!! আজকে কী করলি বাংলাদেশের জন্য? সারা জীবন বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট লীগ খেলে গেলি টাকার বিনিময়ে!’ ‘সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় সাকিব, এইসব বোলারদের সঙ্গে অন্য কেউ না খেললেও সাকিব খেলেছে, সাকিব জানে কী করে খেলতে হয়।
অথচ সে সিরিয়াসলি খেলল না।’ ‘বোলিংয়ে ১ ওভারের পর আসেননি, ব্যাটিংয়েও কিছু করতে পারলেন না আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব।’ দর্শকরা আরও বলেছে, ‘সাকিব প্রতারণা করেছেন! তামিমকে আনফিট বলেছিলেন! তাহলে নিজে কেন ফিট না হয়ে বিশ্বকাপে খেলতে গেলেন?’ আরও কিছু দর্শকের মন্তব্য, ‘সাকিবের চোখে যদি সমস্যা হয়, তাহলে খেলবে কেন, ভালো পারফর্ম না করলে তাকে দরকার নেই সে সাকিব হোক বা যেই হোক। জাতীয় দল আবেগের জায়গা নয়।’
ক্রিকেটার তামিম ইকবাল বলেছেন, ‘এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ২ ম্যাচে মাত্র ৪ ওভার বল করেছেন সাকিব, নিতে পারেননি কোনো উইকেট। ব্যাট হাতে ২ ম্যাচে রান করেছেন মাত্র ১১।’ ক্রিকেটার বীরেন্দর শেহবাগ সাকিবের খেলা নিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘সাকিব যদি অভিজ্ঞতার কারণে দলে থাকে, তাহলে আমরা সেটা দেখতে পাইনি। অন্তত কিছু সময় উইকেটে কাটান, আপনি হেইডেন বা গিলিক্রস্ট নন, যে কি না শর্ট বলে পুল শট খেলতে পারে। আপনি একজন বাংলাদেশি খেলোয়াড়, ওই মানের খেলা খেলুন। যখন আপনি পুল বা হুক খেলতে পারবেন না, তখন যেসব শট আপনি জানেন সেগুলোই খেলুন। আপনি এত সিনিয়র খেলোয়াড়। দীর্ঘদিন অধিনায়কও ছিলেন।
এরপর আপনার এমন পারফরম্যান্স! আপনার তো নিজেরই লজ্জা হওয়া উচিত। নিজে থেকে বলা উচিত আমি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেব।’ শেহবাগের এই মন্তব্য বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকের পছন্দ হয়েছে, কারও কাছে মনে হয়েছে বীরেন্দর শেহবাগ সাকিবকে অপমান করতে গিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটকেই মূলত অপমান করেছেন।
কেউ বলছে, ‘দল ভর্তি হুজুর থাকার পরও খেলায় হারতে হয় কেন? এত দোয়া, এত নামাজ, এক্কেবারে কনফার্ম জান্নাতি হাবভাব, তারপরও জিততে পারেনি। কী লজ্জা!’ ‘মাঠে পারফর্ম না করতে পারলে, পরিশ্রম না থাকলে, অধ্যবসায় না থাকলে দোয়াতে কিছুই হবে না।’ অনেকের অভিমত, ‘মাহমুদুল্লাহর ছক্কাটা যদি আর দুই ইঞ্চি ওপর দিয়ে যেত, তাহলেই তো জিতে যেতাম। চার না হওয়ার জন্য যে শত্রুতা করে এলবিডবল্যু দেওয়া হলো, সেটি না দিলেই তো জিতে যেতাম।’ আবার কারও কারও মত আম্পায়ারের বিরুদ্ধে। বলেছে, ‘ক্রিকেট আর ভদ্রলোকের খেলা নেই। এটি পরাশক্তিদের খেলা। আর আম্পায়াররা সবসময় শক্তিশালী দলের পক্ষে থাকে, যেমনটা ভাগ্যও। বিশ্বকাপের মতো আসরে এমন আম্পায়ারিং রীতিমতো ন্যক্কারজনক!’ লোকে এও বলছে, ‘আমাদের ক্রিকেট সিস্টেমে এটাই সমস্যা। বর্তমানে ফরমে না থাকলেও অতীতের ইতিহাস দেখে অনেক প্লেয়ারকে সুযোগ দেয় ম্যানেজমেন্ট। এই সিস্টেমটা পরিবর্তন হওয়া দরকার, সেই সঙ্গে প্লেয়ারদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে আলাদা আলাদা সিরিজে ভিন্ন ভিন্ন প্লেয়ারকে সুযোগ দেওয়ার কালচার তৈরি করা উচিত।’
আমার বোন ম্যাচ দেখতে দেখতে রীতিমতো উত্তেজিত। খেলোয়াড়রা তাড়াহুড়া করে চার আর ছক্কা মারতে গিয়ে উইকেট হারাচ্ছে, এ সে কিছুতেই মানতে পারছে না। অন্যান্য আত্মীয়রা লক্ষ্য করেছি সাকিবের ওপর ক্ষুব্ধ। তারা এলবিডবল্যু নিয়ে কোনো দ্বিধা প্রকাশ করেনি। এলবিডবল্যুর সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না বলেই তারা মনে করে। তবে সবাই মিলে চেষ্টা করলে যে বাংলাদেশ জিততে পারত, এ বিষয়ে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। আমার মত হলো, আমি খেলা উপভোগ করেছি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। উত্তেজনাময় ছিল খেলার সবটা সময়। পিচটা বোলিংয়ের জন্য ভালো, ব্যাটিংয়ের জন্য ভালো নয়। সুতরাং বেশি রান আশা করিনি। অল্পের জন্য হেরেছে বটে, তবে বাংলাদেশের ছেলেরা ভালো খেলেছে। এ ছাড়া কী আর বলা যায়! অভিযোগ করলে তো অভিযোগের শেষ থাকবে না। কেউ আজ ভালো খেললে কাল খারাপ খেলে। তেমন, কেউ আজ খারাপ খেললেও কাল ভালো খেলবে এই আশা নিয়েই থাকতে হয়।
তানজিম প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন, ‘মানসিকভাবে খুব শক্তিশালী আমাদের দল। আমরা চাইলে যে কোনো দলকে হারাতে পারি। আমাদের ১১ জন যদি মাঠে সেরাটা দিতে পারে, কোনো দল আমাদের সামনে ব্যাপার না ইনশাআল্লাহ। আমরা যে কোনো দলকে হারানোর মতো দক্ষতা রাখি।’-এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেও তাহলে কেন হেরে যাচ্ছ বাছা! আশা করছি সামনের ম্যাচগুলোয় বাংলাদেশ ভালো খেলবে। বিশ্বকাপে, আজ না হোক আগামী দিন খুব ভালো ফল করবে, এ আমার বিশ্বাস।
আমার আত্মীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম প্রচণ্ড। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় আবেগে তাদের চোখে জল জমেছে। আমেরিকায় জন্ম হওয়া বা আমেরিকায় বেড়ে ওঠা অনেক তরুণ-তরুণীও লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছে। নিজের মা-বাবার দেশটিকে নিজের দেশ ভাবতে মোটেও তাদের অসুবিধে হয়নি। বাঙালির নতুন প্রজন্মের জন্য এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা বটে। দেশ দরিদ্র হলেও দেশের মানুষের দেশপ্রেম যে মোটেও দরিদ্র নয়, তা বেশ টের পেয়েছে।
হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে গিয়েছে। দর্শকদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগই বাঙালি। দক্ষিণ আফ্রিকার ভক্ত সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। আমি তো টিকিটের দাম শুনে অবাক। আমার আত্মীয়রাই একেকটি টিকিট কিনেছে প্রায় ৫০০ ডলার দিয়ে। বাংলাদেশি টাকায় একটি টিকিটের দাম ৫৮ হাজার টাকা। ২৪০ ডলার খরচ করে বাংলাদেশের জার্সি কিনেছে তারা। কেন? দেশের জন্য ভালোবাসা থেকেই তো! আমার ভাইপো আমেরিকায় বড় হয়েছে, সে বেসবল, বাস্কেটবল, টেনিস ভালো বোঝে, ক্রিকেট ভালো বোঝে না। তারপরও জন্মের দেশ বাংলাদেশকে ভালোবেসে সে চড়া দামের টিকিট কিনে স্টেডিয়ামে গিয়েছে। জাতীয় সংগীতের কথাগুলো ভালো জানে না, তারপরও গলা ছেড়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছে।
সুরটা অন্তরে, তাই বেসুরে গায়নি। আমি ভেবেছিলাম দেশের জন্য এক বুক গৌরব নিয়ে সে স্টেডিয়াম থেকে ফিরবে। কিন্তু হতাশ হলো সেও। আমেরিকায় বাস করা নতুন বাঙালি প্রজন্ম দেশ নিয়ে গৌরব করার বেশি কিছু পেল না। দেশ সম্পর্কে যা জানে তারা, তা হলো দেশে দরিদ্ররা ভুগছে, ধনীরা দুর্নীতি করছে, পুলিশের সর্বোচ্চ পদে থেকে হাজার কোটি টাকা লুট করে পালিয়ে যাচ্ছে, সরকারি দলের ভেতরে থেকেও মানুষ টাকা আত্মসাৎ করছে, নিয়মনীতি বলে কিচ্ছু নেই, সরকারের চাটুকারিতা করলেই দেশে বাস করা সম্ভব, সরকারের সমালোচনা করলেই দুঃসহ জীবন, জেলভোগ, গণতন্ত্র বলতে কিছু নেই সে দেশে, মেয়েরা ধর্ষণের ভয়ে, ধর্মের ভয়ে বস্তাবন্দি হয়ে থাকে, পুরুষেরা ভিনদেশি আলখাল্লা পরে থাকে।
যে বাংলা ভাষার জন্য বাঙালিরা রক্ত দিয়েছে, সেই বাংলা ভাষা থেকে শব্দ সরিয়ে আরবি শব্দকে জায়গা দেওয়া হচ্ছে। নিজের ভাষাকে কেউ আর ভালোবাসতে চাইছে না। ঋণে জর্জরিত দেশ। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। ধনীরা লুটপাট করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। মধ্যবিত্তরা ধনী হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। দরিদ্রদের নিয়ে ভাবার কেউ নেই। অপচিকিৎসা বাড়ছে। হাসপাতালে প্রতারকদের দৌরাত্ম্য, যে কোনো সাধারণ চিকিৎসার জন্যেও বাংলাদেশের রোগীদের ভারতে, থাইল্যান্ডে, সিঙ্গাপুরে যেতে হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় কিছুদিন পরপরই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। জীবনের কোনা নিরাপত্তা নেই। বাক-স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।
যুব সমাজের বড় একটি অংশ নেশায় আক্রান্ত। আল আমীন নামের এক লোক এক স্কুলছাত্র জিসানের গলায় রুপার চেইন ছিনতাই করার জন্যই চকলেটের লোভ দেখিয়ে জঙ্গলে নিয়ে খুন করেছে। মাদকদ্রব্য কেনার জন্য মাদকাসক্ত লোকেরা খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধা করছে না। পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালিরা বসবাস করছে। হিন্দুদের জমি দখল করে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। ধর্মনিরপেক্ষ স্কুল কলেজে পুত্রকন্যাদের না পাঠিয়ে অভিভাবকরা পাঠাচ্ছে মাদরাসায়। ধর্মান্ধতা নতুন প্রজন্মের মধ্যে অবিশ্বাস্য রকম বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যেও এই প্রবণতা প্রচণ্ড। অনেকে প্রশিক্ষণ এবং পরিশ্রমের চেয়ে বেশি ভরসা করছে ভাগ্যের ওপর, ভরসা করছে মানুষের দোয়ার ওপর।
দোয়ায় কোনো লাভ হয় না জেনেও মানুষ দোয়ার ওপর ভরসা করছে। আমার সোনার বাংলা যদি সত্যিকার সোনার বাংলা হতে চায়, তবে ক্রিকেটে ম্যাচ জিতলেই হবে না, দেশকেও ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে জিততে হবে। শুধু তাই নয়, ধনী এবং দরিদ্রের পার্থক্য কমাতে হবে, দেশকে সুস্থ ও সুন্দর করতে হবে, মানুষকে সভ্য, শিক্ষিত এবং সৎ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি সত্যিকার গৌরবের সঙ্গে গাইতে পারবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আপামর বাঙালি।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।