ইলিশ মাছের জীবনচক্র অন্য যেকোনো সামুদ্রিক অথবা মিঠাপানির মাছের মতো নয়। সামুদ্রিক অথবা মিঠাপানির মাছ হয় সমুদ্রে নয়তোবা নদীর মিঠাপানিতে তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করে। কিন্তু ইলিশ মাছ দুটো পরিবেশই ব্যবহার করে নিজের বংশ বৃদ্ধি করার জন্য। তাই ইলিশ মাছকে বলা হয় অ্যানড্রোমাস ফিশ। স্যামন মাছও কিন্তু একই ধরনের একটি মাছ। ইলিশ মাছ তাদের জীবনের একটি বড় অংশ কাটায় সমুদ্রের লোনাপানিতে এবং যখনই তাদের ডিম পাড়ার সময় হয়, তখন তারা দল বেঁধে নদীর মোহনাগুলোতে চলে আসে।
সেখানে মিঠাপানির সংস্পর্শে নিজেদের ডিম পাড়ার জন্য প্রস্তুত করে। ইলিশ মাছ বছরে দুবার ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশের পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনায় যেমন ভোলার চরফ্যাশন ও মনপুরা, হাতিয়ার মৌলভির চর, সন্দ্বীপের কালিরচরে আসে। একবার অক্টোবর-নভেম্বর মাসে, আরেকবার ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। ডিম পেড়ে ইলিশ আবার ফিরে যায় সমুদ্রে। বাচ্চা ইলিশ, যাদের আমরা জাটকা নামে জানি, তারাও কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পরে খাবার এবং দৈহিক গঠন বৃদ্ধির জন্য মিঠা থেকে লোনাপানির সাগরে পাড়ি জমায়।
জাটকা মাছ নদী ও নদীর মোহনায় অবস্থান করে ৪ থেকে ৫ মাস। যখন তাদের শরীর লবণাক্ত পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত হয়, তখনই কেবল তারা পরিবেশ পরিবর্তন করে। সমুদ্রে গিয়ে পরিণত হয়ে এক থেকে দেড় বছর পর তারা আবার ডিম পাড়ার জন্য নদীতে ফিরে আসে। এভাবেই ইলিশ মাছের জীবনচক্র আবর্তিত হতে থাকে।
ইলিশের এই জীবনচক্রের অনেক ব্যাপারই বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা। যেমন: কেন ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য নদীতে ফিরে আসে? তার শরীরের জিনোমের কী কী পরিবর্তন তাকে ফিরে আসতে সাহায্য করে। লোনাপানিতে বসবাস করার জন্য তাকে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, আর কেনই–বা তাকে সমুদ্রে যেতে হয় বৃদ্ধির জন্য? এটা কি শুধু খাবারের জন্য, নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে এর মধ্যে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে যদি তার জিনোমকে আমরা সঠিকভাবে পড়তে পারি।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া এই তিন মহাদেশের একটি সমন্বিত গবেষক দল অত্যন্ত সফলভাবে ইলিশ মাছের জীবনরহস্য উদ্ঘাটন করেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যাদের হাত ধরে সফলতার মুখ দেখেছে তাঁরা হলেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জৈবপ্রযুক্তিবিদ মং সানো মারমা এবং বাংলাদেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী হাসিনা খান ও তাঁর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবের একদল তরুণ গবেষক, মোহাম্মাদ রিয়াজুল ইসলাম, ফারহানা তাসনিম চৌধুরী, জুলিয়া নাসরিন, অভিজিৎ দাস, অলি আহমেদ, তাসনিম এহসান, রিফাত নেহলীন রেজা প্রমুখ।
এ ছাড়া গবেষণা দলে আরও যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের হেরা বায়োসায়েন্সের প্রধান পিটার ইনাকিয়েভ এবং অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন ক্রস বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ বায়োইনফরমেটিশিয়ান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ কে এম আবদুল বাতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নেয়ামুল নাসের, যাঁর ইলিশ গবেষণায় ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে, তিনিও এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সর্বোত্তম প্রযুক্তির মাধ্যমে ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচনের কাজ অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করে এ গবেষক দলটি। সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ও অধ্যাপক মোহাম্মাদ শামসুল আলমের নেতৃত্বে ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। কোনো জীবের জিনোম সিকোয়েন্সপ্রক্রিয়া নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করতে হলে কিছু বিষয়ের ওপর সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
যেমন জিনোম অ্যাসেম্বলি কতটা সঠিক, সিকোয়েন্স অ্যানোটেশন সঠিকভাবে হয়েছে কি না, যেটা পরোক্ষভাবে নির্ভর করে জিনোমের পর্যাপ্তসংখ্যক অন্তর্নিহিত সম্পদের ওপর [যেমন তার Transcriptome Data বা জিনোম থেকে কখন কী প্রোটিন তৈরি হয়, সে তথ্যের ওপর বা জিনোমের যে অংশ প্রোটিন তৈরি করে না (Non-coding) তাদের বৈশিষ্ট্যের ওপর]।
ইলিশের ক্ষেত্রে জিনোম ডেটায় যেসব উপাত্ত পাওয়া গেছে, তা নিঃসন্দেহে উন্নত মানের ছিল, যা পরে বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়। ইলিশের পুরো জিনোমকে ১ বিলিয়ন অক্ষরে (base pair-chemical unit) লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে এবং বিভিন্ন বায়োইনফরমেটিক টুল ব্যবহার করে ইলিশে উপস্থিত প্রায় ৩০ হাজার জিন খুঁজে পাওয়া গেছে। এই জিনোম থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে ইলিশের গবেষণাক্ষেত্রকে আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।