রিয়াদ খন্দকার : বছর দুই হলো দ্বিতীয় সন্তান দুনিয়াতে এসেছে, অথচ খান সাহেব (বাচ্চার বাবা) এবারও সবাইকে জানাতে ভুলে গেলেন। গতবারের মত এবারও দোষ চাপালেন বাচ্চার মায়ের ওপর। জানালেন, তার নাকি পরে ঘটা করে জানানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শিশুর মাতৃকূল এবারও নাকি সেটা করতে দেয়নি, আফসোস! এমন অপছন্দের কাজ করায় ওইসব বেগমদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়! কী বিস্ময়কর পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালন! সব দায় বেগমদের, খান সাহেব এবারও রইলেন ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে!
বলছিলাম, ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের নায়ক, কথিত নাম্বার ওয়ান শাকিব খান এর কথা। এক শ্রেণির মানুষ পয়সা খরচ করে যাকে হল-এ গিয়ে দেখেন। আবার আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে গণসংবর্ধনাও দেয়! একবার নয়, বারবার একই কাণ্ড ঘটিয়েও তিনি প্যাডেলে ব্রেক দেন না। এর পরিণামে ক’দিন পর পর অপু, বুবলিরা সন্তান জন্ম দেন, আর ওই সন্তানদের বাবা খোঁজার দায়িত্ব পড়ে সাংবাদিকদের কাঁধে।
নারীর আত্মসম্মান ও মর্যাদা বিনষ্ট করবার যে ক্রণিক রোগ খান সাহেবকে পেয়ে বসেছে তাতে আমরা ধারণা করতেই পারি, ভবিষ্যতে জয় ও বীর হয়ত আরও সিরিয়াল সহোদর পেতে চলেছে। নায়িকাদের অন্তঃসত্ত্বা করার ক্ষেত্রে খান সাহেবের এই উদারতা নিয়ে রসিক নেটিজেনরা ফেসবুকে চালু করেছেন ‘কেউ ফিরে না খালি হাতে, শাকিবের দরবার থেকে’। নেটিজেনদের এই রসিকতা অপু ও বুবলির মর্মপীড়ার কারণ হতে পারে বটে! কিন্তু দর্শকের কাছে নিজের জীবন ছাড়া বাকি সবই সিনেম্যাটিক।
শাকিব খান চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসকে গোপনে বিয়ে করেন ২০০৮ এর দিকে, আট বছর সংসার করেছেন গোপনে। যখন খেয়াল হলো মানুষটি আর তার পাশে নেই, অন্য কারো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন তখন ২০১৭ সালের দিকে হঠাৎ করে বাচ্চা নিয়ে মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হন অপু বিশ্বাস। কান্নাকাটি করে স্বামীর অধিকার আদায় করতে জনগণের সামনে দাঁড়ান। খান সাহেব এতে বেশ ক্ষুব্ধ হন, ‘বউ কথা শুনে না’ তত্ত্ব দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দেন।
পরবর্তীকালে দ্বিতীয় স্ত্রী চিত্রনায়িকা বুবলী যখন আশংকা করলেন, স্বামী আগের সংসারে ফিরে যেতে পারে বা নতুন কোনো প্রেমে মজেছেন তখনই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ফেসবুকে নিজের বেবি বাম্পের ছবি পোস্ট দিলেন, তারপরেই পোস্ট করেন শাকিব খানের সঙ্গে বাচ্চার ছবি। গত ২৬ অক্টোবর শাকিব খান গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমার অপছন্দের এমন কাজ করে সবার কাছে আমাকে ছোট করার পরও কি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায়?’ মানে তার পুরোনো তত্ত্ব ‘বউ কথা শুনে না’। বউ কথা শোনে না, বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না, এসব কথা যেহেতু পুরুষশাসিত সমাজের পক্ষে যায়, ফলে আরেকটা বিয়ে করা সহজ হয়। কেউ প্ৰশ্ন করে না, দাম্পত্য কলহ থাকলে একজন লোক সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে কি না।
বোধ করি অপু বিশ্বাস বা বুবলীরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত নারী হলেও নিজেদের শাকিব খান ছাড়া প্রতিবন্ধীই মনে করেন। খান সাহেব যতই অন্যায় করুক তাদের তাতে কিছুই যায় আসে না। তারা যেকোন শর্তে শাকিব খানের স্ত্রী হয়েই থাকতে চান। এটাই তাদের একমাত্র পরিচয়। ফলে এই নায়িকারা কোনোভাবেই নারী সমাজের আইডল হতে পারেন না। আর এইদিকে আমাদের নায়ক দেখাতে চান তিনি চিরকুমার। তিনি প্রেম, আনন্দ, বউ, বাচ্চা সবই চান কিন্তু সংসারী হতে চান না। ব্যক্তিগত জীবন জনসমক্ষে প্রকাশের পরপরই তিনি বউদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। মনে করেন তারা শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
একটি ইংরেজি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাকিব খান যা বলেছেন–তা বিবেকবান মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন! তার মতে, ‘প্রেম, বিয়ে ও সন্তান প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। এগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করার বিষয় নয়।’ এই তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের দেশে বিয়ে, গাঁয়ে হলুদ, বৌভাত, বেবি শাওয়ার, আকিকা ইত্যাদি সামাজিক রীতিনীতিগুলো একেবারেই অযথা। বরং চুপিচুপি বিয়ে করে একটা বাচ্চা ধরিয়ে দিয়ে তারপর বৌকে ছেড়ে দাও। খেল খতম, পয়সা হজম!
গতবারের মত এবারও খান সাহেবের নাকি ইচ্ছা ছিল, সময়মতো সুন্দর আয়োজনের মাধ্যমে ঘটা করে বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে, সবার সঙ্গে একসঙ্গে আনন্দ করার। কিন্তু অপু বা বুবলী কেউই তাকে সেই সুযোগ দেননি। সম্ভবত তারা বুঝে গিয়েছিলেন বাচ্চাগুলোর আঠারো পেরোলেও খান সাহেবের সেই কাঙ্ক্ষিত সময় আর আসবে না। তিনি চকচকে ব্যাচেলর হিরো সেজে পর্দার সামনে পেছনে চুটিয়ে প্রেম করে যাবেন।
মূলত প্রত্যেকটা টিপিক্যাল বাঙালি পুরুষের মগজেই এমন একজন শাকিব খান বাস করে। নারীকে অবমূল্যায়ন করে এই দাম্ভিক পুরুষ হয়ে উঠার ক্ষেত্রে সমাজের ভূমিকা অনেক। নারী চাইলেও সন্তানকে শুধু নিজের একক পরিচয়ে বড় করানোর মতোন সামাজিক ব্যবস্থা এখানে নেই। এই দেশে কাগজে-কলমে মা সন্তানের প্রকৃত ‘মালিক’ বা ‘স্বত্ত্বাধিকারী’ নন। আইন মতে, বাবা হলেন সর্বেসর্বা। মা হলেন কেবল ‘অভিভাবক’।
মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ব্যক্তিগতের সীমানা পেরিয়ে বহুজনের আইকন, আইডল, প্রিয়জন। তাদের কাজকর্মের ফল-কুফল একক বা একান্ত পারিবারিক সীমানায় থাকে না। এর প্রভাব পড়ে হাজার-হাজার মানুষের ওপরও। তাই সিরিয়ালি নারী ও শিশুদের জীবন ইচ্ছাকৃতভাবে বিচ্ছেদের নরক নামিয়ে দেয়া খান সাহেবের এই আচরণের নিন্দা করি। শিল্পী হওয়ার আগে মানুষ হওয়া চাই। মন ও মননে যতদিন না তিনি মানুষ হয়ে উঠছেন, ততদিন তাকে নায়ক হিসেবে মেনে নেওয়া ঠিক হবে না।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, সচেতন নাগরিক সবারই উচিত এমন কাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। তা না হলে দেশের আপামর পুরুষকূল ভেবে বসতে পারে, শাকিব খানের অপকর্মই বুঝি চলমান শুদ্ধ আইন। তা যদি হয়, সেটা হবে আমাদের নারী প্রগতির জন্য বিরাট অন্তরায় এবং প্রকান্তরে নারী ও পুরুষের যূথবদ্ধতায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা।
লেখকঃ গণমাধ্যম কর্মী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।