ব্জুমবাংলা ডেস্ক : এক বছর আগে চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুন কেড়ে নিয়েছিল ৭১ জনের জীবন৷ সেই জীবনগুলোর বিনিময়ে তাদের অনেকের পরিবার পেয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ৷
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র অবশ্য বলেছেন, ক্ষতিপূরণের জন্য তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার এই ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে৷
কিন্তু অবৈধ কেমিক্যাল কারখানার জন্য দায়ীরা সবাই এখনো আইনের আওতায় আসেনি৷ সরেনি কেমিক্যাল গোডাউন ও প্লাস্টিক কারখানা৷ আগুনের সূত্রপাত যে ভবন থেকে, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনে এখনো আগুনের ভয়াবহতার চিহ্ন থাকলেও বাকি ভবনগুলো মেরামত করা হয়েছে৷ জীবনযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে এসেছে স্বাভাবিক৷ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আবারো একইভাবে আগুন আশঙ্কা রয়েছে৷
এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেই কোনো অগ্রগতি৷ এক বছরে দেয়া হয়নি ময়না তদন্ত প্রতিবেদন৷ এ পর্যন্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার তারিখ ৯ বার পিছিয়েছে৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে৷
গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত৷ ওই আগুনে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনসহ ৫টি ভবন পুরোপুরি ভস্মিভূত হয়৷ আর আগুনে ৭১ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন অনেকে৷
আগুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, ‘‘ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ তাদের চারতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ রাখতেন৷ মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বাসা ভাড়া দেন৷ আর ওই দাহ্য পদার্থ থেকেই আগুন লাগে৷” যদিও প্রথমে প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছিলো যে, রাস্তায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লাগে৷ বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বিষ্ফোরণের কাহিনীও ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল৷
মামলার এজাহারভুক্ত আসামি দুই ভাই হাসান ও সোহেল গ্রেপ্তার হলেও পরে উচ্চ আদালত থেকে তারা জামিন পান৷ পুলিশ বলছে, গোডাউনের অন্য মালিকদের ঠিকানা নিশ্চিত হতে না পারায় তাদের এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি৷
চুড়িহাট্টা মসজিদের আশেপাশের বাড়িগুলোতে ছিল রাসায়নিক দ্রব্যের গোডাউন৷ রাস্তায় বিস্ফোরিত একটি গাড়ি থেকে প্রথমে রেস্টুরেন্টে, তার পরে আশেপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার মোহাম্মদ সিদ্দিক উল্লাহ ( ৪৫) চুড়িহাট্টা এলাকার একটি প্লাস্টিক কারখানার গোডাউনে কাজ করতেন৷ ওই দিন আগুনে তিনি নিহত হন৷ তার বড় ছেলে আহসান উল্লাহ এখন চকবাজারে একটি প্লাস্টিকের দোকানে কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বাবার লাশ আনার সময় মর্গে আমাদের ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়৷ পরে প্লাস্টিক কারখানার মালিক সমিতি ৫০ হাজার টাকা দেয়৷ আর আমাদের নোয়াখালীর এমপি দেন এক লাখ টাকা৷ এর বাইরে আমরা কোনো সহায়তা পাইনি৷’’
তারা পাঁচ ভাই-বোন৷ আহসান উল্লাহ সবার বড়৷ তিনি এখন যে চাকরি করেন, তাতে বেতন মাত্র ছয় হাজার টাকা৷ ছোট ভাই-বোনদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে৷
আগুনের পর ওই এলাকায় অবৈধ প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয় সিটি কর্পোরেশন৷ তবে তা সফল হয়নি৷ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় মালিকরা৷ ওয়াহেদ ম্যানশন ছাড়া আর সব ভবনেই আবার কেমিক্যাল গোডাউন এবং প্লাস্টিক কারখানা চালু হয়েছে বলে জানান আহসান উল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘‘আজও (১৯ ফেব্রুয়ারি) আমি চুড়িহাট্টায় গিয়েছিলাম৷ নিহতদের পরিবারের আরো অনেক সদস্য গিয়েছিলেন৷ তাদের অবস্থাও একই রকম৷ অধিকাংশ পরিবারই হাসপাতাল মর্গের ওই ২০ হাজার টাকাই পেয়েছে৷ আর কিছু পায়নি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ওখানে আগের মতোই দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে৷ কেমিক্যাল গোডাউন, প্লাস্টিক কারখানা আবারো চালু হয়েছে৷ তবে কিছুটা গোপনে৷’’
আগুনে নিহত জুম্মন মিয়ার ছেলে আসিফ হোসেন এখন চকবাজারেই একটি টেইলরিং শপে চাকরি করেন৷ তিনি এই ঘটনায় মামলারও বাদী৷ আসিফ হোসেন বলেন, ‘‘আমরাও ২০ হাজার টাকা পেয়েছি৷ আর কোনো সহায়তা পাইনি৷ অপরাধীরা আইনের আওতায় আসেনি৷ আমাদের দাবি, যারা এই আগুনের জন্য দায়ী তারা বিচারের আওতায় আসুক৷’’
চুড়িহাট্টা এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায়৷ দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগুনের পর ওই এলাকার প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন নতুন জায়গায় সরিয়ে নেয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়৷ তাদের জন্য কেরানীগঞ্জে আলাদা পল্লী হবে৷ কিন্তু সেজন্য শিল্পমন্ত্রণালয় কাজ করছে৷ আর এখন নতুন করে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ওই এলাকার ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমকে উন্নত করা হয়েছে৷ খুব দ্রুত যাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আর স্থানীয়ভাবে ১৫-২০ মিনিট যাতে ফায়ারের বিরুদ্ধে ফাইট করা যায়, তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷’’
নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটি তালিকা করেছি৷ সেই তালিকা ধরে আগামীকাল (২০ ফেব্রুয়ারি) আগুনের বছর পূর্তিতে ক্ষতিপুরণ দেবো৷ কাউকে চাকরি, কাউকে নগদ টাকা এবং কাউকে দোকান করার সহায়তা দেবো৷ ক্ষতি বুঝে আমরা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করছি৷’’
চকবাজার অগ্নিকাণ্ড: চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর
নরক
চুড়িহাট্টা মসজিদের আশেপাশের বাড়িগুলোতে ছিল রাসায়নিক দ্রব্যের গোডাউন৷ রাস্তায় বিস্ফোরিত একটি গাড়ি থেকে প্রথমে রেস্টুরেন্টে, তার পরে আশেপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷
ভবন ধস
প্রথমে আগুন লাগে ওয়াহিদ মঞ্জিল নামের একটি ভবনে৷ সেখানে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ ছিল৷ আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টা পরেই ধসে পড়ে আরিফ ম্যানশন নামের পাশের একটি ভবন৷
মৃত্যুর মিছিল
ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের পোড়া মরদেহ মর্গে পাঠান উদ্ধারকর্মীরা৷ পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে৷ ঘটনার পর মামলা হয়৷ এর তদন্তের অগ্রগতি দূরে থাক এখনও নিহতদের ময়নাতদন্তই শেষ হয়নি৷
হাজী ম্যানশন এখন
এটি চুড়িহাট্টায় ক্ষতিগ্রস্ত হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন৷ ভবনটির দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে৷ বেঁকে গেছে জানালার রডও৷ ভবনটি এখন পরিত্যক্ত৷
আগুন নেভানোর চমকপ্রদ সব আবিষ্কার
ফায়ারফাইটিং ড্রোন
ড্রোনের সুবিধা হলো এটি নীচে দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ কয়েকটি কোম্পানি এরই মধ্যে ফায়ারফাইটিং ড্রোন বাজারে ছেড়েছে৷ যেখানে এখন পর্যন্ত ক্রেন দিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ মিটারের কিছু বেশি উচ্চতায় পৌঁছানো যায়, সেখানে অ্যারোনেস কোম্পানির ড্রোনগুলো ৩শ’ থেকে ৪শ’ মিটার উচ্চতায় যেতে পারে এবং এগুলো মিনিটে ১০০ লিটার গতিতে পানি ছিটাতে পারে৷ শুধু তাই নয় ১৪৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের কোনো ব্যক্তিকেও এটি তুলে আনতে পারে৷
সাউন্ডওয়েভ ফায়ার এক্সটিনগুইশার
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির দুই প্রকৌশল ছাত্র ট্র্যান ও রবার্টসন ২০১৭ সালে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন৷ যদিও আগুন নেভানোর জন্য শব্দের ব্যবহারের আইডিয়া আগে আলোচিত বা পরীক্ষা করা হয়েছে, একে বাস্তব যন্ত্রে রূপান্তর করেছেন এই দু’জন৷ যন্ত্রটি দিয়ে ১০০ হার্টজ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করে আগুনে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়৷ আর ম্যাজিকের মতো মুহূর্তেই আগুন নিভে যায়৷
বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫
এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার হলো বিরাট আগুন (যেমন, ওয়াইল্ড ফায়ার) নেভানোর কাজে ব্যবহারযোগ্য বিমান৷ এর মধ্যে বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫ ক্যানাডায় তৈরি একটি বোমারু বিমান, যেটি আগুনের মধ্যে বোমার মতো পানি ফেলে অল্প সময়েই নিভিয়ে ফেলে৷ মাত্র ১২ সেকেন্ডে এটি ৬ হাজার ১শ’ ৪০ লিটার পানি ছড়াতে পারে৷ এটি উভচর৷
স্কাইক্রেন
স্কাইক্রেনও এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার৷ এটি একটি মার্কিন হেলিকপ্টার৷ এটিও অনেক দ্রুতগতিতে আগুনে পানি ছিটাতে পারে৷ মাত্র ৪৫ সেকেন্ডে ১০ হাজার লিটার পানি ছিটাতে পারে এই স্কাইক্রেনটি৷ এটি একটি মিলিটারি মডেলের হেলিকপ্টার৷ বিখ্যাত অ্যানিমেশন মুভি ‘দি ইনক্রেডিবল হাল্ক’-এ এই মডেলটি ব্যবহার করা হয়েছে৷ সূত্র : ডয়েচে ভেলে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।