জুমবাংলা ডেস্ক : এ বয়সে শিশুরা মা-বাবার পাশে থাকে। মেতে ওঠে কৈশোরের দুরন্তপনায়। স্কুলে আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া করে। শিশু মোজাম্মেলের বেলায় তা হয়নি। সাত বছর বয়সী শিশুটির এখন রাত কাটছে হাসপাতালের বিছানায়।
মাদ্রাসার পাষণ্ড শিক্ষকের নি র্যাতনের আতঙ্কে ঘুমাতেও পারে না সে। গভীর রাতে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আর রাত জেগে সন্তানের পাশে থেকে চোখের অশ্রু ঝরান অসহায় পিতা-মাতা।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের হাতির থান হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র মোজাম্মেল হোসেন। গত শুক্রবার তার জীবনে নেমে আসে যেন সাক্ষাৎ নরক। মাদ্রাসার এক পাষণ্ড শিক্ষক প্রথমে তার চোখ বাঁধেন গামছা দিয়ে। তারপর ৩০ মিনিট ধরে সমস্ত শরীরে বেত দিয়ে আঘাত করেন ওই শিক্ষক। নি র্যাতনে শিশুটির দুই চোখই নষ্ট হওয়ার উপক্রম বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বর্তমানে সে ঢাকার ফার্মগেটের খামারবাড়ি অবস্থিত ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মোজাম্মেলের বাবা বিলাল হোসেন এ ঘটনায় হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেছেন। মামলায় নি র্যাতনকারী শিক্ষক হাফেজ নাঈম আহমেদ ও তার পিতা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলাম আলফুকে আসামি করা হয়েছে।
শিশু মোজাম্মেলের মা রেহানা খাতুন বলেন, ছেলে হাফেজ হবে, মাওলানা হবে- এই আশায় মাদ্রাসায় দিয়েছিলাম। সম্প্রতি মাদ্রাসার অন্য ছাত্রদের সঙ্গে একটি বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায় মোজাম্মেল। সেখান থেকে মোজাম্মেলকে ২০ টাকা উপহার দেওয়া হয়। দাওয়াত খেয়ে মাদ্রাসায় ফিরে আসলে ওই ২০ টাকা দাবি করেন শিক্ষক হাফেজ নাঈম। এতে সম্মত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছেলেটিকে এই অমানুষিক নি র্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রেহানা খাতুন বলেন, গত শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মাদ্রাসায় বসে লুডু খেলছিলেন শিক্ষক হাফেজ নাঈম আহমেদ। এ সময় মোজাম্মেল গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। হঠাৎ বিরক্ত হয়ে মোজাম্মেলকে বেধড়ক বেত্রাঘাত শুরু করেন ওই শিক্ষক। মারপিটে ছেলেটির দুই চোখ তেঁতলে গেছে। এ ছাড়া বেতের আঘাতে শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত হয়। প্রথমে গামছা দিয়ে মোজাম্মেলের চোখ বেঁধে বেত দিয়ে আঘাত করা হয়। পরে অন্য ছাত্রদের দিয়ে হাত-পা ধরিয়ে রেখে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে নি র্যাতন চালানো হয় তার ওপর। একপর্যায়ে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু বারান্দা থেকে মাঠে ছুড়ে ফেলা হয় মোজাম্মেলকে।
নি র্যাতনের বিষয়টি মা-বাবাকে জানালে মোজাম্মেলকে জানে মেরে ফেলার হুমকিও দেন শিক্ষক নাঈম। পরদিন শনিবার মোজাম্মেলের মাকে মাদ্রাসা থেকে জানানো হয়- তাঁর ছেলে দুর্ঘটনায় ব্যাথা পেয়েছে। ছুটে এসে ছেলেকে মারাত্মকভাবে আহত দেখে নিয়ে যাতে চান তিনি।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রথমে নিয়ে যেতে না দিলেও পরে তোপের মুখে মায়ের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয় মোজাম্মেলকে। ওইদিনই তাকে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসক কোনো চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখানোর পরামর্শ দেন। রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) তাকে হবিগঞ্জ আধুনিক চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে ওইদিন সন্ধ্যায় তাকে এখানে সেখানে ভর্তি করা হয়।
হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রথীন্দ্র দেব বলেন, মোজাম্মেলের দুই চোখের আঘাত মারাত্মক। এ ছাড়া তার পুরো শরীরজুড়েই আঘাতের চিহ্ন।
মোজাম্মেলের বাবা বিল্লাল মিয়া বলেন, চিকিৎসকরা একাধিকার পরীক্ষা করে বলেছেন চোখ দুটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অন্তত এক মাস ধরে চিকিৎসা করলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া শরীরজুড়ে আঘাত থাকায় বাইরে অন্য চিকিৎসক দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিল্লাল বলেন, আমি পেশায় একজন গরুর পাইকার। ইতিমধ্যে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এত ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার দেনা দাবি করা হচ্ছে। এখন ঢাকায় থেকে চিকিৎসা করানো যেমন ব্যয় বহুল তেমনিভাবে আমার ছেলের মাঝে যে আতংক বিরাজ করছে তাতে আমাদের অনেক কষ্ঠ হচ্ছে।
হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুক আলী বলেন, ‘নি র্যাতনকারী শিক্ষক ও মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যালকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেছেন মোজাম্মেলের পিতা। তাদেরকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও নি র্যাতনকারী শিক্ষকের পিতা মোজাম্মেল হোসেন আলফু বলেন, ‘আমি সোনালী ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখায় এসএ পদে চাকরি করি। ঘটনার পর থেকে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।’ এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শিক্ষা ও আইসিটি শামসুজ্জামান বলেন, আমরা বিষয়টি জেনেছি। এ ব্যাপারে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লুকড়া ইউনিয়নের যাদবপুর গ্রামে হাবিবা আক্তার নামে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে বেত মেরে এক চোখ স্থায়ীভাবে অন্ধ করে দেন নিরঞ্জন দাস নামের এক শিক্ষক। এক মাসেই দুই ঘটনায় হবিগঞ্জের অভিবাবকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।