বাস্তবায়ন যোগ্য ৫ দফা দাবি তিনদিনের মধ্যে বাস্তবায়ন হলেই বুয়েটের ১৪ তারিখের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তা না হলে পরীক্ষা হবে না।
শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য ৫টি দাবি তুলে ধরে এগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে বলা হয়, যেহেতু ভিসি অনুরোধ করেছেন আর সামনে নতুনরা আসবেন সে বিষয়টি বিবেচনা করে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী কাল থেকে যথারীতি আগের মতোই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এর আগে শুক্রবার বুয়েট অডিটোরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনাকালে বুয়েটের উপাচার্য বলেন, ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলে তাদের সকল দাবি বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য করার জন্য তিনি ছাত্রদের আন্তরিক সহযোগিতা চান।
এ সময় তিনি বেশ কিছু ঘোষণাও দেন। বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম এর দেয়া ঘোষণাগুলো হলো-
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুক্রবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে বৈঠকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান বুয়েটের উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম। ভিসি বলেন, আমি আমার ক্ষমতাবলে বুয়েট ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলাম। এখন থেকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে ডিসিপ্লিনারি বোর্ডের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আবরারের বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এবং মামলার খরচ বুয়েট কর্তৃপক্ষ বহন করবে।
এর আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করার পক্ষে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রশাসন চাইলে তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে বলে মত দেন তিনি।
১৯ শিক্ষার্থী বহিষ্কার: আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত বুয়েটের ১৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথা বৈঠকে শিক্ষার্থীদের জানান ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম। তিনি আরো জানান, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে।
সরকারকে চিঠি: আবরার হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য আজ/কালকের মধ্যেই সরকারকে চিঠি দেয়া হবে জানিয়েছেন বুয়েট ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।
অতীতের সব নির্যাতনের বিচার হবে: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) র্যাগিং বন্ধের ঘোষণা দিয়ে অতীতের সব ঘটনা তদন্ত করে বিচার করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। এছাড়া র্যাগিং বন্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। তিনি জানান, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসের মধ্যে সিসিটিভি বসানো হবে। এ জন্য সময়ের প্রয়োজন রয়েছে।
রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন না বুয়েট শিক্ষকরা: এখন থেকে দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন না বুয়েট শিক্ষকরা। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সাথে শিক্ষকদেরও রাজনীতি বন্ধে এমন ঘোষণা দেন ভিসি।
ভিসির ক্ষমা প্রার্থনা: বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যুতে নিজের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন ভিসি অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম। এছাড়া আবরার ফাহাদের জানাজায় উপস্থিত হতে না পারায়ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আমার কিছুটা ভুল হয়েছে, আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আবরার আমার সন্তানের মতো ছিল। তোমাদের যেমন কষ্ট লাগছে তার মৃত্যুতে আমারও অনেক খারাপ লেগেছে। এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। তার মৃত্যুতে দুঃখ তোমরা পেয়েছ, আমিও পেয়েছি। আমরা সকলেই মর্মাহত। আমার কিছুটা ভুল হয়েছে, আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার ভুল আমি স্বীকার করেছি, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও।
এর আগে বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে উপাচার্য অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করেন। শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বিভিন্ন অনুষদের ডিনরা বৈঠকে উপস্থিত রয়েছেন। বৈঠকের শুরুতে নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, বৈঠকে ১০ দফা দাবি ও আবরার হত্যার ঘটনায় উঠে আসা ইস্যুগুলো নিয়ে ভিসির কাছে জবাব চাওয়া হবে।
প্রথমে গণমাধ্যমের সামনে আলোচনা করতে রাজি না হলেও অনেক আলোচনা ও আন্দোলনের পর গণমাধ্যমের সামনে আলোচনা করতে রাজি হন উপাচার্য। তবে, আলোচনা সভা সরাসরি সম্প্রচার না করার শর্ত জুড়ে দেন উপাচার্য। উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করতে বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া বহিরাগত ও অন্যদের প্রবেশ রুখতে বুয়েট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের গেইটে বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে তালা দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখে প্রবেশ নিশ্চিত করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ১০ দফা গুলো হলো:
১. খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে: সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শনাক্তকারী খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা সবাইকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল পাঁচটার মধ্যে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. মামলা চলাকালে সব খরচ এবং আবরারের পরিবারের সব ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে। এ মর্মে অফিশিয়াল নোটিশ ১১ তারিখ পাঁচটার মধ্যে প্রদান করতে হবে।
৪. আবরার হত্যায় দায়ের করা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সব প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের আপডেট করতে হবে।
৫. অবিলম্বে চার্জশিটের কপিসহ অফিশিয়াল নোটিশ দিতে হবে।
৬. বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে বুয়েট হলে হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে রাখা হয়েছে। জুনিয়র মোস্ট ব্যাচকে সব সময় ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক জোর করে রাজনৈতিক মিটিং–মিছিলে যুক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেকোনো সময় যেকোনো হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের জোর প্রদর্শনপূর্বক হল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে হলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এমন কর্মকাণ্ডে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ। তাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে (১৫ অক্টোবর) বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। তাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে আজ বেলা দুইটার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে।
৮. আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধে করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লা হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
৯. পূর্বের ঘটনা এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা যেকোনো ঘটনা প্রকাশের জন্য একটা কমন প্ল্যাটফর্ম, কোনো সাইট বা ফর্ম থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বুয়েটের বিআইআইএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে এবং ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে। পরবর্তী ১ তারিখের মধ্যে কার্যক্রম পূর্ণরূপে শুরু করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব হলের প্রত্যেক ফ্লোরে উইংয়ের দুপাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকা এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ায় শেরেবাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে শেষেরটি এরই মধ্যে পূরণ হয়েছে। শেরেবাংলা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল খান গত বুধবারই পদত্যাগ করেছেন।
প্রসঙ্গত, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় খুন হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করে শনিবার বিকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ফাহাদ। এর জের ধরে রোববার রাতে শেরেবাংলা হলের নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে তাকে ডেকে নিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পিটুনির সময় নিহত আবরারকে ‘শিবিরকর্মী’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালায় খুনিরা।
তবে আবরার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে নিশ্চিত করেন তার পরিবারের সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা।
হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ না রাখতে সিসিটিভি ফুটেজ মুছে (ডিলিট) দেয় খুনিরা। তবে পুলিশের আইসিটি বিশেষজ্ঞরা তা উদ্ধারে সক্ষম হন। পুলিশ ও চিকিৎসকরা আবরারকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পেয়েছেন।
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ইতিমধ্যে পুলিশ ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছেন। ১৩ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
গ্রেফতার আসামিরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন, অনীক সরকার, বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, ইফতি মোশাররফ সকাল, বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না, ছাত্রলীগের সদস্য মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, মোহাজিদুর রহমানকে, শামসুল আরেফিন, মনিরুজ্জামান ও আকাশ হোসেন, মিজানুর রহমান (আবরারের রুমমেট), ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা এবং হোসেন মোহাম্মদ তোহা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।