নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকের এক কোণায় বসে পড়েন ৭৮ বছরের মো. আব্দুল খালেক। ছোটদের বই সাজিয়ে রাখেন তার পুরোনো কাঠের বাক্সে। পথচারী বা হাসপাতালে আসা-যাওয়া করা মানুষদের কাছে বই বিক্রিই তার জীবনের ধ্যানজ্ঞান।
১৯৬৫ সালে কালীগঞ্জ বাজারে হাতে গোনা কয়েকটি পুরোনো বই নিয়ে তার যাত্রা শুরু। তখন স্থানীয় পর্যায়ে বইয়ের দোকান ছিল আঙুলে গোনা, কিন্তু খালেকের স্বপ্ন ছিল বড়—“শিক্ষা যেন সবার হাতে পৌঁছায় সাশ্রয়ী দামে”। সেই স্বপ্নের টানে কেটে গেছে ৬০ বছর।
আজও প্রতিদিন কেউ না কেউ তার কাছে আসে—পুরোনো দিনের গল্প শুনতে, শৈশবের পাঠ্যবই খুঁজতে, কিংবা নিজের সন্তানের জন্য প্রথম বই কিনতে। গাজীপুরের কাপাসিয়ার বারিসাব ইউনিয়নের বাসিন্দা খালেক কিশোর বয়সে বাবার হাত ধরে কালীগঞ্জে আসেন। তার বাবা কাজ করতেন তৎকালীন এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম মসলিন কটন মিলে। মাধ্যমিক পাস না করতে পারলেও খালেকের মন পড়ে ছিল বই আর শিক্ষার মাঝে। তাই বই বিক্রিকেই পেশা বানিয়ে নেন।
বয়সের ভারে শরীর এখন আগের মতো সাড়া দেয় না। চোখে কম দেখেন, তাই ভরসা চশমায়। কয়েক বছর আগে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, তবুও সেরে উঠে আবার ফিরে এসেছেন প্রিয় পেশায়। বর্তমানে স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই পাশে। একমাত্র কন্যা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে।
খালেকের কণ্ঠে গর্ব। তিনিবেলেন, “আমার ব্যাংক ব্যালেন্স নেই, কিন্তু যারা আমার কাছ থেকে জীবনের প্রথম বই কিনে শিক্ষক, ডাক্তার, লেখক হয়েছে—আমি তাদের সাফল্যকে নিজের সাফল্য মনে করি। নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির চেয়েও বড় ভাবি।”
কালীগঞ্জ পৌরসভার ভাদার্ত্তী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, “আমরা তখন এমসিএম হাই স্কুলে পড়ি। নতুন বই কেনা সবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। খালেক ভাইয়ের কাছ থেকে পুরোনো বই কিনে মাধ্যমিক শেষ করেছি।”
লেখক ও চিকিৎসক অসীম হিমেল বলেন, “ডিজিটাল যুগে বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে। খালেক মিয়ার মতো মানুষরা যেন আলোর রাখাল—যারা মনে করিয়ে দেন, মানুষকে গড়তে এবং জাতিকে জাগাতে এখনো বইয়ের বিকল্প নেই।”
খালেক মিয়ার হাতে ধরা বই শুধু কাগজ নয়—এ যেন ৬০ বছরের এক নিরলস সংগ্রামের প্রতীক, যেখানে লুকিয়ে আছে হাজারো পাঠকের স্বপ্ন, শৈশব আর স্মৃতি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।