কাসেম শরীফ : ফতোয়া বা ফাতওয়া শাশ্বত ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। ইসলাম ও ফতোয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ফতোয়াবিহীন মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবন কল্পনাও করা যায় না। প্রখ্যাত অভিধানবিদ রাগেব ইসফাহানি (রহ.) লিখেছেন, ‘সর্বসাধারণের জন্য ইসলামী শরিয়তের যেসব বিধান বোঝা কঠিন, শরিয়াহ বিশেষজ্ঞের পক্ষ থেকে তার সমাধান দেওয়ার নাম ফতোয়া।’ (রাগেব ইসফাহানি, আলমুফরাদাত ফি গরিবিল কোরআন, আলমাকতাবাতুত তাওফিকিয়্যাহ, কায়রো, পৃষ্ঠা : ৩৭৫)
বিজ্ঞ আলেমদের পক্ষ থেকে ফতোয়া দেওয়ার এই প্রক্রিয়াকে আরবিতে ‘ইফতা’ বলা হয়। এর স্বরূপ সম্পর্কে ‘মাওয়াহিবুল জালিল’ নামক গ্রন্থে এসেছে, ‘ফতোয়া দেওয়ার অর্থ হলো, কারো ওপর (জোরপূর্বক) আরোপ করা ছাড়া ইসলামের বিধান বর্ণনা করা।’ (আবু আবদুল্লাহ আল হিত্বাব, মাওয়াহিবুল জালিল, দারুর রিদ্বওয়ান, ২০১০, পৃষ্ঠা : ৬/৮৬)
ফতোয়া দেওয়ার বিষয়টি ইসলামে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে মহান আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য এই বিশেষ গুণ সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘‘(হে নবী) মানুষ আপনার কাছে ‘কালালাহ’ (উত্তরাধিকার আইনের বিশেষ শাখা) সম্পর্কে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন, আল্লাহ তোমাদের ‘কালালাহ’ সম্পর্কে ফতোয়া (বিধান) দান করেছেন…।’’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৭৬)
শরিয়তে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে সর্বপ্রথম ফতোয়াদানকারী হলেন স্বয়ং রাসুল (সা.)। তাঁর পর থেকে হাজার বছর ধরে ফতোয়া দেওয়া-নেওয়ার এই ধারা চলমান।
মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম এই মহান দায়িত্ব পালন করেন। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেন, সাহাবায়ে কেরামের যুগে ১৩০ জনের চেয়ে বেশি সাহাবি ফতোয়া দিতেন। আর সাধারণ সাহাবি ও সাধারণ তাবেয়িরা সেসব ইসলামী আইনজ্ঞদের কাছ থেকে মাসআলা জেনে আমল করতেন। (ইবনে হাজম, ইহকামুল আহকাম খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৮৮; ইবনুল কাইয়্যিম, ইলামুল মুয়াককিয়িন, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭-১৮)
সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেয়িদের যুগে এ কাজের পরিধি বেড়ে যায়। মক্কায় আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.), ত্বাউস ইবনে কাইসান ও ইকরামা (রহ.); ইয়েমেনে মুহাম্মদ ইবনে সাউর ও আবদুর রাজ্জাক ইবনে হাম্মাদ (রহ.); মিসরে ইয়াজিদ ইবনে আবি হাবিব, আমর ইবনে হারেস (রহ.) প্রমুখ ফতোয়ার এই গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাচীন মুলকে শামে (সিরিয়া, জর্দান ও ফিলিস্তিন) আবু ইদরিস খাওলানি, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) এ দায়িত্ব পালন করেছেন। কুফা ও ইরাকে আলকামা, ইবরাহিম নাখায়ি, মাসরুক (রহ.) প্রমুখ এ খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। অতঃপর ইবরাহিম নাখায়ি (রহ.)-এর শিষ্য ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এ পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছেন। মদিনায় প্রসিদ্ধ সাত মুফতি ও তাঁদের শিষ্যরা এ দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া বসরায় হাসান বসরি (রহ.), বাগদাদে কাসেম ইবনে সাল্লাম (রহ.) এ দায়িত্ব পালন করেছেন। (আবু আবদুল্লাহ, মারিফাতু উলুমিল হাদিস, পৃষ্ঠা : ১৯৮-১৯৯)
তাবেয়িনের যুগের শেষের দিকে ও তাবে-তাবেয়িদের যুগের সূচনালগ্নে ইসলামী ফিকহের মহাবিপ্লব সাধিত হয়। সেটি ছিল আব্বাসীয় যুগের সূচনাকাল। সে যুগে ফিকহ ও ফাতওয়া প্রদান একটি শাস্ত্রে রূপ নেয়। ইসলামের ইতিহাসের এই অবিস্মরণীয় দায়িত্ব পালন করেছেন ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)। তিনি তাঁর হাজারো ছাত্র থেকে বাঁচাই করে ৪০ জন ছাত্রের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন। বিশেষ মাসআলার ক্ষেত্রে দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফাতওয়া আকারে লিপিবদ্ধ করা হতো। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে ঠিক কতগুলো মাসআলা রচিত হয়েছে, তার সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। তবে মুয়াফফাক আলমক্কি (রহ.)-এর মতে, সেসব মাসআলার সংখ্যা কিছুতেই ৮৩ হাজারের চেয়ে কম নয়। (মুয়াফফাক ইবনে আহমাদ আলমাক্কী, মানাকিবু আবি হানিফা : ২/১৩৬)
এর পর থেকে যুগে যুগে, দেশে দেশে ফিকহ ও ফাতওয়ার এই ধারা চলমান। কখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কখনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে মুসলিম বিশ্বের মুফতিরা এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে দেশে দেশে বিভিন্ন ফতোয়া বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মিসরে ‘মুজাম্মাউল বুহুসুল ইসলামিয়্যাহ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জর্দানে ‘লাজনাতুন লিল ইফতা’ গঠিত হয়। ১৯৬১ সালে সৌদি আরবে ‘হাইআতু কিবারিল উলামা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মালয়েশিয়ায় ‘লাজনাল ফাতওয়া’ গঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে রাবেতা আলআলম আলইসলামীর অধীনে মক্কাস্থ ‘আলমুজাম্মাউল ফিকহিল ইসলামী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে নয়াদিল্লির ‘মুজাম্মাউল ফিকহিল ইসলামী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ফতোয়া দেওয়া হয়। পরে সেগুলো গ্রন্থ আকারেও প্রকাশিত হয়। আধুনিক যুগে কুয়েত সরকারের উদ্যোগে ‘আল-মাউসুআতুল ফিক্বহিয়্যা আলকুয়েতিয়্যা’ নামে সর্ববৃহৎ কলেবরে ইসলামী আইন বিশ্বকোষ প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, হাজারো মাদরাসা এবং লাখো আলেমের এই বাংলাদেশে মাতৃভাষায় পূর্ণাঙ্গ ফতোয়ার গ্রন্থ নেই। মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশে এই সংবাদ অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় এই শূন্যতা পূরণ করতে ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান (রহ.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ’ থেকে ১২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত’। এটি বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ ফতোয়াগ্রন্থ।
‘মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ’ (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, বাংলাদেশ) ইসলামী ফিকহ ও আইনের উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ৫ মে ১৯৯১ সালে পথচলা শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে আলেম শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চতর ইসলামী ফিকহ বিভাগ। পাশাপাশি সর্বসাধারণের জিজ্ঞাসা-জবাবের জন্য ‘দারুল ইফতা’ বিভাগ রয়েছে। এখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রশ্নের লিখিত ও মৌখিক সমাধান দেওয়া হয়ে থাকে। যেকোনো প্রশ্নে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক সমাধান বের করে তা ফতোয়া বোর্ডে উপস্থাপন করা হয়। সবার নিরীক্ষণের পর একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে স্বাক্ষরসহ তা প্রকাশিত হয়। ‘মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ’-এর প্রায় ৩০ বছরের পথপরিক্রমায় রেজিস্টারভুক্ত এ ধরনের ফতোয়ার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। ‘ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত’ সেসব ফতোয়ার গ্রন্থিত রূপ। তবে এসব ফতোয়া থেকে বাছাই, পুনর্বিন্যাস ও একীভূত করে এই গ্রন্থে মোট পাঁচ হাজার ২৫৯ ফতোয়া সংকলন করা হয়েছে। এটি ১২ খণ্ডে এবং ছয় হাজার ৭৩৮ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। এই ফতোয়াগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য হলো—
এই গ্রন্থ বাংলাদেশের ইফতা ও ফাতওয়া বিভাগের স্বপ্নদ্রষ্টা ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রচিত হয়েছে।
একটি ফতোয়া বোর্ডের অধীনে যুগশ্রেষ্ঠ ইসলামী আইনজ্ঞদের সত্যায়নে তা সংকলিত হয়েছে।
প্রতিটি ফতোয়া ইসলামী আইনের চার মূলনীতির (কোরআন-সুন্নাহ-ইজমা-কিয়াস) আলোকে গ্রন্থিত হয়েছে।
প্রতিটি ফতোয়ার সঙ্গে পর্যাপ্ত তথ্য-সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। ফতোয়ার উৎস আহরণে বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও ভাষার ফতোয়াগ্রন্থের নজির টেনে আনা হয়েছে।
ফতোয়া সংকলনের ক্ষেত্রে সমকালীন যুগ-জিজ্ঞাসা, মুসলমানদের দৈনন্দিন মাসআলা উল্লেখের পাশাপাশি ঈমান ও আমলের প্রায় সব বিষয় সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
দৃষ্টিনন্দন অঙ্গসজ্জা ও বিন্যাসে ঝকঝকে অফসেট পেপারে গ্রন্থটি ছাপা হয়েছে।
বৃহৎ কলেবরের এই গ্রন্থের বিক্রয়মূল্য চার হাজার টাকা। ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, বাংলাদেশ থেকে তা সংগ্রহ করা যাবে। প্রয়োজনে ০১৮৩৮-৪২৪৬৪৭ নম্বরে কথা বলে পরামর্শ ও সহযোগিতা নেওয়া যাবে। আমরা বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।