ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন : চিকিৎসাবিজ্ঞানের আজকের চরম উৎকর্ষের যুগে করোনাভাইরাস নামের এই যে মহামারীটি দোর্দণ্ড প্রতাপে মানব সমাজের ওপর ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে আর চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কোনোভাবেই একে বাগে আনতে পারছে না তার কারণ কী?
অনেক কারণই থাকতে পারে, তবে মূল কারণ বোধ হয় এই যে, আমাদের বিজ্ঞানীরা এখনও এ অদৃশ্য আততায়ীটাকে ঠিক চিনে উঠতে পারেননি।
এটি আপনাকে ধরছে, ভোগাচ্ছে আর পারলে আপনার জানটাই কবজ করে আল্লাহ গফুর-উর-রহিমের দরবারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সমাজে এটি একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। একবার যখন আপনি এর পাল্লায় পড়ছেন, আপনার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, এমনকি চিকিৎসকেরাও আপনার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে সাহস করছেন না।
আপনি আক্রান্ত হয়েছেন সন্দেহ হলেই যেন রাতারাতি অচ্যুৎ হয়ে যাচ্ছেন। কারণ, যিনিই আপনার ধারে-কাছে আসছেন, এই ভয়ংকর দানব তাকেই আক্রমণ করে বসছে। ফলে, চাইলেও কেউ আপনার তেমন কোনো সাহায্য করতে পারছেন না। আবার অনেকেই সব দয়ামায়া ভুলে গিয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। আপনি চরম অসুস্থ বোধ করছেন আর ভাবছেন দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া দরকার, কিন্তু যেই শুনবে আপনি করোনা রোগী, রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সিওয়ালা, এমনকি কোন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারও আপনাকে নিতে চাইবেন না। করোনা suspect? হাসপাতালের ডাক্তার মশাইরা চাইবেন, আপনাকে ভর্তি না করে কিভাবে অন্য কোন হাসপাতালে চালান করে দেয়া যায়। এ যেন কেয়ামতের সেই ভয়াবহ দৃশ্যের কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে: ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’।
রোগী হিসেবে সমাজ-সংসারে আপনার এই যে করুণ অবস্থা, তা আপনাকেও হয়তোবা অনেক সময় অবিবেচক করে তুলছে। আপনি জানেন, এ রোগটি ভীষণ ছোঁয়াচে, যে কেউ আপনার সান্নিধ্যে আসলেই আক্রান্ত হতে পারে। কাজেই, আপনি আক্রান্ত হয়ে থাকলে কিংবা এমনটি অনুমিত হলে আপনারই তো দায়িত্ব অকপটে অন্যদের আপনার ব্যাপারে সাবধান করা।
এবার দেখা যাক, রোগী বা সম্ভাব্য রোগী হিসেবে আপনার যে সামাজিক দায়িত্ব তার প্রতি কতটুকু সুবিচার আপনি করছেন। হাসপাতালে নেয়ার জন্য আপনি যে ড্রাইভারের সাহায্য চাচ্ছেন, তাকে কি আপনার অবস্থাটা বলে দেয়া উচিৎ নয়?
যে ডাক্তার আপনাকে সেবা দেবেন, তাকে কি আপনার পুরো কাহিনী খুলে বলা জরুরি নয়? আপনি যে প্রবাস থেকে এসেছেন কিংবা কোন প্রবাসী/করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন, তা বললে তো ডাক্তার সাহেব আপনাকে পরীক্ষা করার পূর্বে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাটুকু নিতে পারতেন। তা না করে কেন আপনি তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন?
এমন রিপোর্ট আসছে, রোগী জেনেশোনে ডাক্তারের কাছে তিনি যে করোনা পজিটিভ তা গোপন করছেন। এরকম এক রোগীর অপারেশন করতে গিয়ে যেসব ডাক্তার অপারেশনে অংশ নিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, একজন ডাক্তারকে সংক্রমিত করার মানে কী?
তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতে আসা সব রোগী সংক্রমিত হবে, তিনি আইসোলশনে যেতে বাধ্য হবেন এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক রোগী তার সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। আপনি একজনে নিজের তথ্য গোপন করে কতজনের সর্বনাশ করলেন, ভেবে দেখুন তো!
এ পর্যন্ত দেশে যত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, তার একটি বড় অংশ চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। এই যে চরম ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের এ অবদানের কতটুকু স্বীকৃতি আমরা দিচ্ছি। তাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বেমালুম ভুলে গিয়ে প্রথমে ত আমরা হৈচৈ শুরু করে দিলাম: হাসপাতালগুলো করোনা রোগী বলে সন্দেহ হলেই ভর্তি দিচ্ছে না, হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগী দেখতে চাচ্ছেন না, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনাররা সবাই চেম্বার বন্ধ করে গর্তে লুকিয়েছেন।
এরপর, অনেক চিল্লাপাল্লার পর তাদের N-95 মাস্ক বলে যেগুলো সরবরাহ করা হল, অভিযোগ উঠল সেগুলো নকল। সত্যি হলে এটা তো এক ভয়াবহ ব্যাপার। এ মাস্ক পরে করোনা রোগী দেখবেন আর একের পর এক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হবেন। রোগীর সেবা-যত্নে একটু এদিক সেদিক হলেই আমরা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠছি, সেবার মানসিকতা নিয়ে এরা এ পেশায় আসেননি, টাকা কামানোটাই তাদের কাছে মূখ্য।
একবারও ভেবে দেখেছেন কি, আপনি মাত্র একজন রোগী হয়ে উনাদের কাছে গেছেন আর উনাদেরকে আপনার মত শত-সহস্র রোগীর সেবা দিতে হচ্ছে। হাসপাতালে তার একটু নেক-নজর পাওয়ার জন্য আপনার সেকি প্রাণান্ত চেষ্টা! আর লোকালয়ে? অনেকেই বলছেন, ডাক্তারদের এখন বাসা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে না আবার বাসা-বাড়িতে করোনা বয়ে নিয়ে আসেন!
বলছিলাম করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বহুমুখী বিড়ম্বনার কথা। স্রষ্টার রহমতে আপনি করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে জিতে গেলেন, সেরে উঠলেন। কিন্তু, উপরওয়ালার মর্জি যদি হয় আপনাকে নিয়ে যাবেন, তাহলে এ বিশ্বের কোন শক্তিই ত আর আপনাকে ধরে রাখতে পারবে না। এ দেশে কেউ যখন মারা যায়, তখন সবাই সব হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে তার সৎকারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটাই এ তল্লাটের আবহমান সংস্কৃতি। কিন্তু, করোনা নামের আল্লাহর এই গজব মানুষের এই অবশিষ্ট মনুষ্যত্বটুকুও যেন কেড়ে নিতে বসেছে। যত ঝুঁকিই থাক, একজন মানুষ মারা গেলে তার সৎকার তো করা লাগবে। কিন্তু, হায় আল্লাহ! করোনায় মৃত ব্যক্তির কেউই কাফন-দাফন করতে চাচ্ছে না।
এমন রিপোর্ট এসেছে, অনেক মাওলানা জানাজা পড়াতে অস্বীকার করছেন। দেশে এবং দেশের বাইরে অনেক জায়গায়, এলাকায় করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই ভয়ে করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফনে বাধা দেয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু, প্রশ্ন হল, মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কি করোনা ছড়াতে পারে? হুজুগে না মেতে আপনি একটু আপনার যুক্তিবোধকে কাজে লাগাচ্ছেন না কেন?
আপনি যখন হাঁচি-কাশি দেন, নাক ঝাড়েন কিংবা কথা বলেন, তখন আপনার শ্বাসযন্ত্র থেকে যে সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অথবা যে নিঃসরণ আপনার নাসারন্ধ্র দিয়ে বেরিয়ে আসে, সেটাই এই ভাইরাসের বাহন হিসেবে কাজ করে। তাহলে একজন মৃত ব্যক্তি সংক্রমণ ছড়াবে কিভাবে?
তবে, ব্যক্তির শ্বাসযন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার পর মানবদেহের বাইরেও জীবাণুটি কয়েক ঘন্টা জীবিত থাকতে পারে। কাজেই, মৃত ব্যক্তির হাত বা দেহের অন্য কোন অংশ কিংবা কাপড়-চোপড় যদি এ ভাইরাসে দূষিত হয়ে গিয়ে থাকে আর আপনি তা স্পর্শ করেন অথবা যদি আপনি তার নাকে মুখে হাত দেন, তাহলে এসবই অবশ্যি সংক্রমণের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে। কাজেই, যারাই মৃতদেহ সৎকার করবে, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই তা করতে হবে।
গত ২৪ মার্চ এক অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনায় এ বিষয়ে WHO-এর দেয়া বক্তব্য খুবই পরিষ্কার: ‘To date there is no evidence of persons having become infected from exposure to the bodies of persons who died from COVID-19;.’ অর্থাৎ এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশের সংস্পর্শে আসার ফলে এ রোগে সংক্রমণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। [তথ্যসূত্র: Infection Prevention and Control for the safe management of a dead body in the context of COVID-19 | Interim guidance, 24 March 2020, World Health Organization] WHO-এর আর একটি নির্দেশনায় বলা হচ্ছে, ‘Contrary to common belief, there is no evidence that corpses pose a risk of epidemic disease after a natural disaster. Most agents do not survive long in the human body after death. Human remains only pose a substantial risk to health in a few special cases, such as deaths from cholera or haemorrhagic fevers.’ অর্থাৎ প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর মৃতদেহ থেকে সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ জীবাণু মৃত্যুর পর মানবদেহে খুব বেশি সময় বাঁচে না। মানব দেহাবশেষ শুধুমাত্র কলেরা ও haemorrhagic fevers -ঘটিত মৃত্যুর ন্যায় বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। [তথ্যসূত্র: WHO | Risks posed by dead bodies after disasters] পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, WHO-এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে এদেশের স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম legend ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন: ‘করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তিকে নির্ভয়ে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী দাফন-কাফন করুন। অন্যরাও নির্ভয়ে নিজ নিজ ধর্মের নিয়মানুযায়ী সৎকার করুন।’
তিনি আরও বলেন: ‘মৃত ব্যক্তির শরীরে করোনা ভাইরাস বাঁচতে পারে না, তার বৃদ্ধিও হয় না। করোনায় মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য কোন ব্যক্তির শরীরে প্রসারিত হয় না। মৃত ব্যক্তিকে ধর্মীয় মতে সাবান দিয়ে গোসল করালে করোনার প্রসার বন্ধ হয়।’ [তথ্যসূত্র: ভোরের কাগজ, এপ্রিল ০৬, ২০২০]
তাহলে করোনায় মৃত ব্যক্তির সৎকার নিয়ে সমাজে যে panic বিরাজ করছে, তা কতটুকু বাস্তবতা নির্ভর? কি যুক্তি এই অমানবিক আচরণের? কেন এই নির্দয়তা? কি ব্যাখ্যা দেবেন আপনি এসবের? আমি বলব: ‘It’s nothing but ignorance’।
সোসাইটির সাধারণ মানুষের কাছে আমরা সঠিক বার্তাটি পৌঁছে দিতে পারিনি। গাঁও-গেরামের স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে সচেতন করার জন্য শুধু পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভি কিংবা ইন্টারনেটে প্রচারণা চালানো যথেষ্ট নয়। এজন্য এলাকা-ভিত্তিক বিশেষ ক্যাম্পেইনের প্রয়োজন আছে। তবে, শুধু গ্রাম-গঞ্জ নয়, শহর-বন্দরেও আপনি এমন অনেক শিক্ষিত (!) ভদ্রলোকের দেখা পাবেন যারা যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি নিয়ে না ভেবে স্রেফ হুজুগে মেতে উঠেছেন।
লেখক: ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্র : দৈনিক যুগান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।