আন্তর্জাতিক ডেস্ক : করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েছে ব্যক্তিগত অস্ত্র বিক্রি। এ বছরে শুধু মার্চেই বিক্রি হয়েছে অন্তত ২০ লাখ ব্যক্তিগত অস্ত্র। ২০১২ সালের পর দেশটিতে এক মাসে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রির রেকর্ড এটি। যা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে দেশটির নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। তার মধ্যে চলতি বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন।
নির্বাচন ঘিরে বড় ধরণে সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সহিংসাতার বিষয়ে বার বার সতর্ক করে আসছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও।
সাবেক জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা সিগমার গ্যাব্রিয়েল এক নিবন্ধে বলেন, ‘যদি জনগণের ভোট কম পেয়েও ট্রাম্প নির্বাচিত হন তবে, জনগণ এবার সেটি সহজে মেনে নেবে না। কারণ এরই মধ্যে কয়েক দফায় বাইডেন ও ট্রাম্প সমর্থকরা নির্বাচনী প্রচারের সময় সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। তাই নির্বাচন পরবর্তী সংঘাত দীর্ঘায়িত হবে এবং এটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন কিছু ঘটলে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবেন। যেটি তিনি এরই মধ্যে পোর্টল্যান্ড এবং অন্য শহরগুলোতে করেছেন। তখন সংঘর্ষ আরো তীব্র হয়ে উঠবে।’
অন্যদিকে ট্রাম্প যদি নির্বাচনে হেরে যান তবে তিনি ওভাল অফিস (প্রেসিডেন্টের কার্যালয়) ছেড়ে যাবেন না। এটি তিনি এরই মধ্যে কয়েকবার গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন তাকে ভোটে কারচুপি ছাড়া হারানো সম্ভব নয়। এটি যদি সত্যিই হয় তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটিতে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে। তখন সেনাবাহিনী সেখানে হস্তক্ষেপ করবেই। যেটি দেশটিকে ভয়াবহ কোনো পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। এসব সংঘর্ষকে তীব্র রক্তক্ষয়ী করে তুলবে এসব ব্যক্তিগত অস্ত্র।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস আগস্টের শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি বেড়েছে।
অস্ত্র বিক্রির এই হারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন। তিনি নির্বাচিত হলে অস্ত্র বিক্রি সীমিত করবেন এবং অস্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে কঠিন শর্তজুড়ে দেবেন।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে যখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল কড়া লকডাউন, জনমানব শূন্য রাস্তাঘাট তখন অস্ত্রের দোকানগুলোতে ছিল মানুষের লম্বা সারি। দোকান খোলার আগেই এসে উপস্থিত হতে দেখা যায় অনেককে। এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে দেশটিতে বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। এতে দেখা দিয়েছে অপরাধ বৃদ্ধির শঙ্কা। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিগত অস্ত্রের প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাধারণ মার্কিনরা।
অস্ত্র কিনতে আসা একজন মার্কিন নাগরিক বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। তাই নিজের নিরাপত্তা নিয়েও আমি চিন্তিত।’ (নিউ ইয়র্ক টাইমস)
পক্ষান্তরে একজন অস্ত্র বিক্রেতা বলেন, ‘আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি অস্ত্র বিক্রি হতো। মার্চে বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৫০টি। অনেকে জীবনে প্রথমবার অস্ত্র কিনছেন। তাদের অস্ত্র চালানো শিখিয়ে দিতে হয়েছে আমাদের।’ (নিউ ইয়র্ক টাইমস)
যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিশেষজ্ঞ টিমুথি লাইটন বলেন, ‘দেশে বহু মানুষ কোভিড-নাইনটিনে আক্রান্ত। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মানুষের মাঝে অপরাধ বাড়বে। অস্ত্রের সহজলভ্যতা অপরাধ আরো বেশি উস্কে দেবে। যা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত তৈরি করবে সাধারণ মানুষের মাঝে।’
২০১২ সালে বন্দুকধারীর গুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্কুলে ২০ শিশু শিক্ষার্থীসহ ২৭ জন নিহত হন। এর পর দেশটিতে ব্যাক্তিগত অস্ত্র বিক্রি বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সে সব বিক্ষোভকে পাত্তা না দেয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে ব্যক্তিগত অস্ত্রের বিক্রি। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারীর হামলায় নিহতের সংখ্যা। বাড়ছে হামলার ঘটনাও।
এ বছরের আগস্টের ১৬ তারিখ এক রাতেই যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের সিনসিনাটি শহরের একাধিক স্থানে গুলিবর্ষণের ঘটনায় আহত হন অন্তত ১৮ জন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। আগস্টের ৩১ তারিখ বন্দুকধারীর গুলিতে প্রাণ হারান যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি রাজ্যের সেন্ট লুইস পুলিশের কর্মকর্তা ২৯ বছর বয়সী তামারিস এল. বোহানন।
করোনাকালে যখন লকডাউন চলছিল যুক্তরাষ্ট্রে তখন ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ইলিনয়েস অঙ্গরাজ্যের একটি বাণিজ্যিক এলাকায় বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত পাঁচজন নিহত হন। তবে পুলিশের গুলিতে হামলাকারীও নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন পুলিশের ৫ সদস্য। ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ডে একটি স্কুলে হামলার বর্ষপূর্তির একদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি এ হামলার ঘটনা ঘটে। পার্কল্যান্ডের ওই স্কুলে সেদিনের হামলায় অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়। গতবছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির একটি মুদিদোকানে বন্দুকধারীর গুলিতে পুলিশসহ ছয়জন নিহত হয়।
অন্যদিকে ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার আন্দোলনের কর্মীরা ট্রাম্প প্রশাসনের উপর ব্যপকভাবে ক্ষিপ্ত। সাদা চামড়ার পুলিশের নির্যাতনে কালো চামড়ার বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে গত কয়েক মাসে। এটিকে কেন্দ্র করে দেশটিতে চলছে বিক্ষোভ সংঘর্ষ। পুলিশ জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ তারকা খেলোয়াড়কে হত্যা করে। ওই তুরুণের গলা পুলিশ হাঁটু দিয়ে চেপে ধরার ভিডিওতে ভাইরাল হবার পর আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ পুরনো বিরোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। যার প্রভাব নির্বাচনে পড়বে বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। আর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গ সংঘর্ষ শুরু হলে সেটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কারণ দেশটির পুলিশ এই বর্ণবাদি সঙ্ঘর্ষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অভিযোগের তীর পুলিশের দিকেই বেশি কৃষ্ণাঙ্গদের। তাই নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
মার্কিন স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের যোগাযোগ বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা মাইকেল ক্যাপুটো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদেরকে আগামী ৩ নভেম্বরের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই গুলি কিনে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) ক্যাপুটো বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের গুলি কিনে রাখা উচিত। যখন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠান হবে তখন ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়তে চাইবেন না আর তখনই শুরু হবে গোলাগুলি। আপনারা যদি বন্দুক ব্যবহার করেন তাহলে গোলাগুলি কিনে রাখুন; পরে গুলি পাওয়া কঠিন হবে।’
এতে বোঝাই যাচ্ছে দেশটিতে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা কতটা প্রকোট আকার ধারণ করেছে। বেকারত্ব, বর্ণবাদি আগ্রাসন এবং ট্রাম্পের নানা উস্কানিমূলক আচরণের কারণে জনগণের মধ্যেও হতাশা দেখা দিয়েছে। যেটি মানুষকে অসহিষ্ণু করে তুলছে।
এ বছরের শুরুর দিকে এক সাক্ষাৎকারে ডেমোক্রেট প্রার্থী ও ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন বলেন, ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হলে হোয়াইট হাউস থেকে সরে যেতে আপত্তি করতে পারেন।
বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কারণ নেই। ট্রাম্প কখনোই কোনো ব্যাপারে পরাজয় মেনে নেন না; নিজের ভুল স্বীকার করেন না। তিনি নিজেকে আমেরিকার সেরা প্রেসিডেন্ট মনে করেন। এমন একজন আত্মপ্রেমী প্রেসিডেন্ট বিনা ‘যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী’ ত্যাগ করবেন, এটা ভাবার কারণ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল রিপাবলিকান পার্টি সাংস্কৃতিকভাবে রক্ষণশীল, অধিকাংশ নীতিতেই গোঁড়া ও কট্টরপন্থী। রিপাবলিকানদের মূল ভোটার শ্বেতাঙ্গরা। তাদের নির্বাচনী দুর্গ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল, যা ঐতিহাসিকভাবে রক্ষণশীল। বর্তমান রিপাবলিকান পার্টির রাজনৈতিক ভাবতত্ত্ব এতটাই গোঁড়া ও উগ্র যে, একজন মার্কিন তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক নোম চমস্কি রিপাবলিকানদের ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিষ্ঠান ও মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
জো বাইডেনও ট্রাম্পের চেয়ে কম যান না। ট্রাম্পের মতো বেফাঁস মন্তব্য না করলেও কাজের দিক থেকে তারা কেউ কারো চেয়ে কম নয় বলে তিরস্কার করেছেন অনেক মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান স্টাডিজ এবং কম্পারেটিভ লিটারেসি’র অধ্যাপক হামিদ দাবাশি এক নিবন্ধে বলেন, ‘বর্ণবাদ, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ, বন্দুকযুদ্ধ আর বেকারত্বের ইস্যুতে একটি অন্ধকার জগত তৈরি করেছেন ট্রাম্প। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীরা একটি বড় ধরণের দ্বিধার মধ্যে রয়েছেন।’
দাবাশি বলেন, ‘ব্লাক লাইভ মেটারস, কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাসহ সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনাকে সামনে এনে ট্রাম্পেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কোনোভাবেই হিলারি বা বাউডেনকে দেবতার আসনে বসানো যায় না। কারণ তারা গোটা পৃথিবীজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে নরক তৈরি করে রেখেছে সেখান থেকে ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার কাজ করে যাচ্ছেন।’
এক দিকে রাজনৈতিক অস্থীরতা অন্যদিকে নাগরিকদের হাতে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত অস্ত্র। যা প্রতিমাসেই বিপুল পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে। যার উপর ভর করে কিছুদিন পর পরই ঘটছে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনা। মানুষ হয়ে উঠছে অসহিষ্ণু।
অন্যদিকে, চীন, রাশিয়া, তুরস্ক নতুন করে সম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। আর ইরানের সঙ্গে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো শত্রুতা। তাই এই দেশগুলো মার্কিন নির্বাচনে নানা ধরণের ফন্দি আটার চেষ্টা করছে এমন অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কিন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ সহিংসতা উস্কে দিতে এসব দেশ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।