জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশে গত মে মাস থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় চার মাসে তিন বার ছোট থেকে মাঝারি আকারের যে ভূ মি ক ম্প অনুভ‚ত হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের সীমানার ভেতর বা আশেপাশে। ভূ মি ক ম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই এ ধরণের ভূ মি ক ম্প হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আর সে কারণেই ঘন ঘন এমন ভূ মি ক ম্প অনুভ‚ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚-তত্ত¡ বিভাগের বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দু’দিন আগে বা পরে এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভ‚মিকম্পগুলো। বাংলাদেশে সবশেষ ১৪ অগাস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটের দিকে একটি ভূ মি ক ম্প অনুভ‚ত হয় রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায়। মার্কিন ভ‚-তাত্তি¡ক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, এই ভূ মি ক ম্পটির মাত্রা রিখটার স্কেলে ছিল ৫.৫ যা মাঝারি মাত্রার একটি ভূ মি ক ম্প। আর এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার।
এর আগে, গত ১৬ জুন রাজধানীসহ সারা দেশে ৪.৫ মাত্রার মৃদু ভূ মি ক ম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ। আর চলতি বছরের মে মাসের পাঁচ তারিখে আরেকটি ভূ মি ক ম্প হয়েছে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভ‚-তাত্তি¡ক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস এর হিসেব অনুযায়ী, এই ভূ মি ক ম্প মাত্রা ছিল ৪.৩। ভূ মি ক ম্প উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এটিরও গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার।
ভ‚তত্ত¡বিদদের মতে, বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেট নামে দুটি টেকটনিক প্লেটের অবস্থান রয়েছে। এরমধ্যে ইন্ডিয়ান প্লেটটি উত্তর-পূর্ব দিকে এবং বার্মিজ প্লেটটি পশ্চিম দিকে যাচ্ছে।
‘ফলে পরষ্পরমুখী সংঘর্ষ হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের যে সংযোগস্থল সেটা বেশ গভীরে। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে বিশেষ করে সিলেট এলাকায় যেখানে ভূ মি ক ম্প হচ্ছে সেটা স্যালো ডেপথ, অর্থাৎ কম গভীর’।
যে কারণে এমন ভূ মি ক ম্প : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূ মি ক ম্প হওয়ার মতো উৎস হচ্ছে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকা। এখান থেকে মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারে যে পার্বত্য এলাকা রয়েছে সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কিশোরগঞ্জে যে হাওর রয়েছে সেটি দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটা রেখা কল্পনা করা যায়, এই এলাকাটা হচ্ছে দুটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল। আর এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্ব দিকেরটা হচ্ছে বার্মা প্লেট। আর পশ্চিমেরটা হচ্ছে ইন্ডিয়া প্লেট। এ সংযোগস্থলের উপরের ভাগটা অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মনিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত- এই অঞ্চলটি ‘লকড’ হয়ে গেছে অর্থাৎ এখানে শক্তি জমা হয়ে আছে।
‘দুইটা প্লেটের যে সংযোগস্থল, সেটা এখানে স্যালো বা কম গভীর। অর্থাৎ পশ্চিমে পাঁচ কিলোমিটার থেকে শুরু করে পূর্বে ধীরে ধীরে এটা ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর হয়েছে’।
ড. আখতার বলেন, ‘গত হাজার বছরের শক্তি এখানে জমা হয়ে আছে। এর আগে যেসব ঐতিহাসিক ভূ মি ক ম্প এই অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে তার বিভিন্ন বই-পুস্তক এবং পৌরাণিক কাহিনী বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পেরেছি যে, এই এলাকায় বড় ধরণের ভূ মি ক ম্প হয়েছে ৮০০ থেকে হাজার বছর আগে’। এরপর থেকে আবার শক্তি এই এলাকায় জমা হতে শুরু করেছে। ভূ মি ক ম্পের এই গবেষকের মতে, ৮.২ থেকে শুরু করে ৯ মাত্রার ভ‚মিকম্প সংগঠনের মতো শক্তি এই এলাকায় জমা হয়ে আছে। ‘এ শক্তি আজ হোক, কাল হোক, বা আগামী ২৫ বছরেই হোক, এটা বের হতেই হবে, এর কোন বিকল্প নাই’।
সেই বড় ভূ মি ক ম্প যখন হবে তার আগের সময়টাতে এ ধরণের ছোট ভ‚মিকম্প দেখা যায় বলে মনে করেন তিনি। সেটা কয়েক বছর এমনকি ৫-১০ বছর ধরে হতে পারে। ‘গত চার-পাঁচ মাসে আমরা তিন-চারটি ভূ মি ক ম্প দেখলাম। এই সবগুলোই হচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি ভ‚মিকম্প। এটা সাবডাকশন জোনের লকড সেগমেন্টে হচ্ছে’।
এটার মানে হচ্ছে, বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে যেকোন সময় একটি বড় ভ‚মিকম্প সংগঠিত হতে পারে। তবে এই বড় ভ‚মিকম্প কবে হবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
হিডেন ফল্ট আছে কি? : দু’হাজার ষোল সালে প্রকাশিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় একটি গোপন ফল্ট রয়েছে যা বাংলাদেশে ৯ মাত্রার মতো ভ‚মিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবেদনে গোপন এ ফল্টকে মেগাথার্স্ট ফল্ট নামে উল্লেখ করে বলা হয়, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পললের নিচে এই মেগাথার্স্ট অবস্থিত। এটি দুই প্লেটের সাবডাকশন জোন বা দুই প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত এই মেগাথার্স্ট। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚-তত্ত¡ বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশে অসংখ্য ফল্ট রয়েছে। কিন্তু সেসব ফল্ট নিয়ে ভ‚তাত্তি¡করা খুব একটা চিন্তিত নয়। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অসংখ্য ভ‚-চ্যুতি আছে। সমতল এলাকাতেও অসংখ্য চ্যুতি রয়েছে। তবে এগুলো মারাত্মক নয়’।
বাংলাদেশে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত দুই প্লেটের সংযোগস্থল। এই অঞ্চলে গত ৮০০ থেকে হাজার বছরের মধ্যে জমে থাকা শক্তিটা বের হয় নাই। এ কারণে এ অঞ্চল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তার মতে, সাবডাকশন জোন বা দুই প্লেটের সংযোগ স্থলে যে ভ‚মিকম্প হয় তা খুবই ভয়াবহ।
ভূ মি ক ম্পের জন্য পরিচিত রিং অব ফায়ার যেটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত সেটিও সাবডাকশন জোনের অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলে যে ভ‚মিকম্পগুলো হয় সেগুলোর বেশিরভাগই ৭.৫ এর উপরে হয়ে থাকে। এগুলো শক্তিমত্তার দিক থেকে সবসময়ই ধ্বংসাত্মক। এ কারণে এই অঞ্চল নিয়ে চিন্তার বিষয় রয়েছে। তবে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত যে ফল্টলাইন রয়েছে সেখানকার শক্তি ১৭৬২ সালে বের হয়ে গেছে বলে জানা যায়। সেখানে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে।
উনিশশো বাষট্টি সালে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জায়গায় যে ফল্ট লাইন রয়েছে সেখানে ৮.৫ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভ‚মিকম্প হয়। এর ফলে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড তিন মিটার উপরে উঠে আসে। এর আগে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। একই ভ‚মিকম্পে সীতাকুÐ পাহাড়ে কঠিন শিলা ভেদ করে নিচ থেকে কাদা বালুর উদগীরণ হয়। এই ভ‚মিকম্পের কারণে বঙ্গোপসাগরে সুনামি হয়। এই সুনামির কারণে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বাড়িঘর ভেসে গিয়ে সে সময় ৫০০ মানুষের প্রাণহানি হয়।
ছোট ভূ মি ক ম্প হলে কি ঝুঁকি কমে? অনেকে মনে করেন যে, ঘন ঘন ছোট ছোট ভ‚মিকম্প হলে, ভ‚-অভ্যন্তরে জমে থাকা শক্তি ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং এর ফলে বড় ধরণের ভ‚মিকম্পের আশঙ্কা কমে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এই ধারণাটি আসলে সত্য নয়। যে পরিমাণ শক্তি সাবডাকশন জোন বা দুই প্লেটের সংযোগস্থলে জমে থাকে তার পরিমাণ এতোই বেশি যে, এটি বের হয়ে আসলে ৮.২ থেক ৯ মাত্রার মতো ভ‚মিকম্প হতে পারে। এতো পরিমাণ শক্তি ছোট ছোট ভ‚মিকম্পের মাধ্যমে বের হয়ে আসা সম্ভব নয় উল্লেখ করে ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দৈনিক যদি ছোট থেকে মাঝারী আকারের ভ‚মিকম্প হয় তাহলেও এতো শক্তি বের হয়ে আসতে সময় লাগবে দুই থেকে তিনশ বছর।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হয় রিং অব ফায়ারে অবস্থিত এলাকা বা দেশ যেমন জাপান, চিলি, সান ফ্রান্সিসকোতে দৈনিকই মৃদু ভ‚মিকম্প হয়। কিন্তু তারপরও হঠাৎ করেই একেকটা বড় ভ‚মিকম্পের খবর পাওয়া যায়।
“বড় ভমিকম্প তৈরি হওয়ার যে ভ‚-কাঠামো ওই এলাকায় রয়েছে, সেই একই ভ‚-কাঠামো আমাদের এখানেও রয়েছে,” বলেন তিনি।
এক স্কেল থেকে যখন আরেক স্কেলে ওঠানো হয়, সেখানে শক্তির মাত্রা ৩২ গুণ বেশি বলে ধরা হয়। যদি ৩ মাত্রার ভ‚মিকম্পের তুলনায় যদি সেটি ৪ মাত্রায় হয় তাহলে সেখানে ৩২গুণ বেশি শক্তির ভমিকম্প হবে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।