জুমবাংলা ডেস্ক : ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার বর্ণনা দিয়েছেন আসামি রবিউল। রিমান্ডে তিনি জানিয়েছেন, চাকরি হারানোর ক্ষোভ থেকে তার একক পরিকল্পনায় এ হামলা চালানো হয়।
ওই হামলার ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের রবিউল বলেছেন, ইউএনওর টাকা চুরির পর ফেরত দেয়ার সময় তাকে কথা দেয়া হয়েছিল, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না। কিন্তু তারপরও বরখাস্ত করা হয়েছে। একদিকে চাকরি হারানোর যন্ত্রণা, অন্যদিকে আর্থিক সংকট মিলিয়ে ইউএনওর ওপর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষোভ থেকেই হামলার পরিকল্পনা করেন রবিউল।
মঙ্গলবার দুপুরে মামলার তদন্তকারী পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রবিউলের বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন। পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল সেই রাতের ঘটনার বর্ণনাসহ হামলার কারণ জানিয়েছেন। সেই অনুযায়ী সব আলামত জব্দ করা হয়েছে। রিমান্ডে নেয়া সময়ের মধ্যে মামলার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। পুনরায় তাঁকে আর রিমান্ডের দরকার হবে না।
ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার তারই অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রবিউল ইসলাম পুলিশের রিমান্ডে আছেন। আগামী বৃহস্পতিবার তার ছয় দিনের রিমান্ড শেষ হবে।
রবিউলের পরিবারের দাবি, ঘটনার রাতে রবিউল বাসাতেই ছিলেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্তকারী ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রবিউলের পরিবারের পাঁচ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা কে কী বলেছেন, সেসব তথ্যও মিলিয়ে দেখেছেন। হামলাকারী শনাক্ত করতে পুলিশ সিসিটিভির ফুটেজসহ যে প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে, রবিউল তার জবানবন্দিতে প্রতিটি বিষয় স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে মামলার তদন্তকাজে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের পরিবারও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বলে জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
৯ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় পুলিশ রবিউলকে নিজ বাসা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে হামলার দায়ও স্বীকার করেন রবিউল। শনিবার সকালে প্রেস ব্রিফিং করে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় রবিউলের সেই স্বীকারোক্তির কথা জানান। সেদিনই তাঁকে ছয় দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তিন দিনের মাথায় হামলার পরিকল্পনাসহ সেই রাতের ঘটনা বর্ণনা করেন রবিউল।
২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে ফরাস পদে চাকরিতে যোগ দেন রবিউল। বেতন ১৭ হাজার টাকা। ফরাস পদে চাকরিতে যোগ দিলেও জেলা প্রশাসকের বাংলোতে মালির কাজ করতেন। গত বছরের ১ ডিসেম্বর রবিউলকে ঘোড়াঘাট উপজেলায় বদলি করা হয়। সেখানেও মালি পদে কাজ করতে থাকেন রবিউল। দেড় মাস চাকরি করার পরই ইউএনওর ব্যাগ থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরির ঘটনা ঘটে (রবিউলের ভাষ্যমতে ১৬ হাজার)। এতে অভিযুক্ত হন রবিউল। পরে ভাইদের সহযোগিতায় ইউএনওর ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন তিনি। রবিউলসহ তাঁর পরিবার থেকে অনুরোধ করা হয় চাকরি থেকে বরখাস্ত না করার। কিন্তু ১৫ জানুয়ারি ইউএনও তাঁর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিবেদন দিলে ৫ ফেব্রুয়ারি রবিউলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, সঙ্গে বিভাগীয় মামলাও হয়।
কক্ষে ঢোকার সময় শব্দে ইউএনওর ঘুম ভেঙে যায়। ইউএনও তার বাবাকে ডাকতে থাকেন। তখনই ইউএনওর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন রবিউল। পাশের রুম থেকে তার বাবা উমর আলী শেখ আসামাত্রই তাকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেন।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বিজোড়া ধামাহার ভীমরুলপাড়ার মৃত খতিবউদ্দিনের ছেলে রবিউল। পুলিশের ভাষ্যমতে, রবিউলের ক্রিকেট জুয়ার প্রতি আসক্তিও ছিল। একদিকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালীন পুরো বেতনভাতা না পাওয়া, অন্যদিকে ধারকর্যে করে ইউএনওর টাকা শোধ করা। সব মিলিয়ে পারিবারিক অশান্তি আর মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া চাপা ক্ষোভ থেকে ইউএনওকে হত্যার পরিকল্পনা করেন রবিউল।
রবিউল পুলিশকে আরও বলেছেন, ঘটনার দিন দুপুরে সাইকেলযোগে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। দিনাজপুর শহরের ষষ্ঠীতলা এলাকায় মোহাম্মদীয়া হেয়ার কাটিংয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। পরে পাশেই আইনুলের গ্যারেজে সাইকেল রেখে বিকেল চারটায় শহরের ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে উঠে ঘোড়াঘাটের উদ্দেশে গিয়ে রাত সাড়ে নয়টায় পৌঁছান। ঘোড়াঘাট বাজারে কিছু সময় অতিবাহিত করে ওসমানপুর ইউএনওর কার্যালয়ের দিকে আসেন রবিউল। রাত সোয়া ১টার সময় নৈশপ্রহরী পলাশের কক্ষ দিয়েই বাসভবনের কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেন রবিউল। পলাশ তখন গভীর ঘুমে।
আগে থেকেই ইউএনওর বাসভবনের সবকিছুই নখদপর্ণে রবিউলের। যে মই ভবনে ওঠার কাজে ব্যবহার করেছেন, সেই মই দিয়ে কবুতরের খোপ পরিষ্কার করা হতো। জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল জানান, বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেন তিনি। মই বেয়ে প্রথমে বাথরুমের জানালা দিয়ে ওপরে উঠেছেন। কিন্তু বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ থাকায় সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছেন। পরে আবার মই বেয়ে নিচে নেমেছেন।
একপর্যায়ে ইউএনওর রুমের ভেন্টিলেটরে মই স্থাপন করেন তিনি। সেখান দিয়ে কক্ষে ঢোকার সময় শব্দে ইউএনওর ঘুম ভেঙে যায়। ইউএনও তার বাবাকে ডাকতে থাকেন। তখনই ইউএনওর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন রবিউল। পাশের রুম থেকে তার বাবা উমর আলী শেখ আসামাত্রই তাকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। দরজার সঙ্গে জোরে ধাক্কা লাগায় পায়ে আঘাত লাগে তার। উমর আলীর কাছে চাবির সন্ধান নেন। কিন্তু চাবি পেলেও আলমিরা খুলতে পারেননি রবিউল। বিছানার ওপরের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি খাম পকেটে নেন তিনি। এরপর দ্রুত সেই ভেন্টিলেটর দিয়েই মই বেয়ে নিচে নেমে আসে। ভোর ৪টা ৪০মিনিটের দিকে বের হয়ে উপজেলার গেট দিয়ে ওসমানপুর বাজারের মেইন রোড ধরে মহাসড়কে পৌঁছান। মহাসড়কের পাশে ফাঁকা জায়গায় তার হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটি টি-শার্ট বের করে পরনের টি-শার্ট, মাস্ক ও টুপি পুড়িয়ে দিয়ে একটি বাসে দিনাজপুর আসেন।
রিমান্ডে রবিউল আরও জানান, সকাল সাড়ে নয়টার সময় দিনাজপুর শহরের ষষ্ঠীতলা এলাকায় সেই সাইকেল গ্যারেজে গিয়ে ২৫ টাকা পরিশোধ করে সাইকেলটি নিয়ে বাড়িতে যান। ওই দিন বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ছাদকৃষি উদ্বোধনকালে তিনি অফিসেও যান। সন্ধ্যায় ইউএনওর বাসা থেকে আনা খামের ভেতর থেকে পাওয়া ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা বন্ধু খোকন আলীকে দিয়ে পাওনা পরিশোধ করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।