জুমবাংলা ডেস্ক : প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহালে হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চার দফা আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দাবি আদায় না হলে আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে বলে জানান আন্দোলনকারীরা।
জানা যায়, ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে ফের বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্র সমাবেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে কলাভবন, শ্যাডো, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, বিভিন্ন হল ঘুরে ভিসিচত্বর হয়ে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় সমাবেশ থেকে শিক্ষার্থীরা চারটি দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো- ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা। ২০১৮ সালের পরিপত্র বহালসাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সব গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া এবং সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা। সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
দাবি উত্থাপনের পর শিক্ষার্থীরা পুনরায় মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমানের কাছে যান। এ সময় তারা প্রক্টরের কাছে সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি খোলা রাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে হল, ক্যান্টিন খোলা রাখাসহ সব শিক্ষার্থী সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানান। পরে শিক্ষার্থীরা আজ দুপুর আড়াইটায় গণপদযাত্রা কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এ ছাড়া ৪ জুলাই পর্যন্ত সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘৪ জুলাইয়ের মধ্যে আইনিভাবে আমাদের দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহা করতে হবে। আমাদের আশ্বস্ত করতে হবে, যাতে কোটাব্যবস্থার চূড়ান্ত ফয়সালা করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে গ্রন্থাগার খোলা থাকতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের হলসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো হল বন্ধ করা যাবে না, গ্রন্থাগারও বন্ধ করা যাবে না। প্রত্যয় স্কিমের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করি। কিন্তু আমাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো (গ্রন্থাগার, হল ও মেডিকেল) যেন বন্ধ না হয়।’
সমাবেশে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দেন নাহিদ ইসলাম। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে গণপদযাত্রা শুরু হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের একই সময়ে একই কর্মসূচি পালনে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ৩ ও ৪ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যে একত্র হবেন। কাল নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালনের পর ৩ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে সবাই একত্র হবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সারজিস আলম বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মনে করি। তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজনে আরও বৃদ্ধি করা হোক। কিন্তু কোটাবৈষম্য দূর হওয়া প্রয়োজন। আমরা বৈষম্য মেনে নিতে পারি না।
এদিকে, সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল ও সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলনের ডাক দেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কোটা রেখে কোটাপদ্ধতি সংস্কার এবং কোটাভুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাকোটায় শূন্যপদ পূরণ করা, ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একবার কোটা ব্যবহারের সুযোগ রেখে এ পদ্ধতি সংস্কার করা। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও সরকারি চাকরি পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত রাখা।
পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আমানুল্লাহ খান বলেন, আমরা কোটা সম্পূর্ণ বাতিল চাই না। তবে কোনো এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর জন্য বৃহৎ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া বৈষম্য। মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের কম একটা গোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশ কোটা ভোগ মোটেও যৌক্তিক নয়। রেলওয়েতে এটা আবার ৮৬ শতাংশ। এই বৈষম্য বন্ধ করে সব কোটা মিলে ১০ শতাংশ বরাদ্দ এবং জীবনে একবার এই সুযোগ ভোগের নীতিমালা করা বাস্তবায়ন করা হোক। কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা বৃষ্টিতে ভিজে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
সমাবেশে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনের পর আমাদের সঙ্গে কেন বৈষম্য করা হচ্ছে? আমরা ৫৬ শতাংশ কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। সরকারি চাকরিতে কোটা কখনোই কাম্য নয়। চাকরি কোটায় নয়, মেধায় হোক।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোটা পুনর্বহাল বিরোধী আন্দোলনে দিনভর সরব ছিল ক্যাম্পাস। বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি জাবির প্রধান সড়ক হয়ে ডেইরি গেট সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে ১০ মিনিট মহাসড়কের উভয় লেন বন্ধ করে প্রতীকী অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময়, সড়কটির ঢাকা ও আরিচাগামী উভয় লেনে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ছিল।
কোটা পুনর্বহাল বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। অতি দ্রুত কোটা পুনর্বহালের রায় বাতিল না করা হলে আগামী ৪ তারিখ থেকে আমরা আরও কঠোর আন্দোলনে যাব। প্রয়োজনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে ঢাকাকে অচল করে দেওয়া হবে।
জাবির প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবির বলেন, আন্দোলনকারীদের জায়গা থেকে তাদের দাবি যৌক্তিক। এখন পর্যন্ত আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। জবি প্রতিনিধি জানান, ২০১৮ সারের জারিকৃত (কোটাব্যবস্থা বাতিল) পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্র সমাবেশ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে কোটাপ্রথা বাতিলে চার দফা দাবি ঘোষণা করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাসের মূল ফটক থেকে শুরু হয়ে রায়সাহেব বাজার মোড় ঘুরে পুনরায় ক্যাম্পাসের রফিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়। ছাত্র সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা সুস্পষ্ট করে বলে দিতে চাই একটি পরিবার একটি কোটা একবার মাত্র ব্যবহার করবে। একই কোটা বারবার ব্যবহার করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি এমনকি সরকারি চাকরিতেও সুবিধা নেবে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এটা হতে পারে না।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন মুন্না বলেন, এ দেশে সরকারি প্রথম শ্রেণির চাকরিতে কোটাপ্রথা আবার পুনরায় বহাল থাকলে মেধাবীদের ওপর অবিচার করা হবে। কোটা থাকুক আমরাও সেটার বিপক্ষে না কিন্তু ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে। নতুবা এই দেশের ছাত্রসমাজ পুনরায় রক্ত দিয়ে হলেও রাজপথে জোরালো আন্দোলনের মাধ্যমে কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবে। ছাত্র সমাবেশ শেষে আন্দোলনকারীরা বলেন, আমরা পরবর্তী কর্মসূচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে জানিয়ে দেব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।