“আম্মু, স্কুলে টিফিনে সবাই নুডুলস, চিপস খায়… আমিও ওইটা চাই!”
সাত বছরের আদীবের এই কথাগুলো শুনে তার মা, শারমিন আক্তারের মনটা ভারী হয়ে উঠল। ঢাকার ব্যস্ত শহুরে জীবনে, অফিসের চাপের মাঝে আদীবের জন্য প্রতিদিন সুষম খাবার রেডি করা, আর তার পছন্দের জাঙ্ক ফুডের আকর্ষণ রোধ করা – দুটোই যেন কঠিন যুদ্ধ। শারমিনের মতো লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি মা-বাবার প্রতিদিনের সংগ্রাম এটি। কিন্তু এই সংগ্রামের ফলাফলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এমনকি শিক্ষার সাফল্যও।
বাংলাদেশে শিশু অপুষ্টি ও স্থূলতা – দুই চরমই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। জাতীয় পুষ্টি সেবার (National Nutrition Services) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ২৮% শিশু খর্বকায় (stunted), অর্থাৎ তাদের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে প্রায় ১০% এ পৌঁছেছে (সূত্র: icddr,b গবেষণা পত্র, ২০২২)। এই দ্বিমুখী সংকটের মূলে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসের অভাব, জাঙ্ক ফুডের সহজলভ্যতা এবং সঠিক তথ্যের ঘাটতি। এই জায়গাতেই একটি সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং বাংলাদেশি পরিবেশে উপযোগী শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা হয়ে উঠতে পারে সোনামণিদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রূপকার। এটি শুধু খাবারের তালিকা নয়, তাদের শারীরিক বৃদ্ধি, মেধার বিকাশ এবং রোগমুক্ত জীবনের ভিত্তি রচনা করে।
শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা: কেন অপরিহার্য, শুধু তালিকা নয়, বোঝাপড়া জরুরি
‘শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা’ বলতে আমরা শুধু কিছু খাবারের নামের তালিকাই বুঝি না। এটি একটি গতিশীল কাঠামো, যা শিশুর বয়স, শারীরিক চাহিদা, ক্রিয়াকলাপের মাত্রা এবং আমাদের বাংলাদেশি খাদ্যাভ্যাস ও প্রাপ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই তালিকার মূল উদ্দেশ্য:
- সর্বোত্তম শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশ: হাড়, মাংসপেশি, দাঁত ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুস্থ গঠনের জন্য প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন ডি-এর মতো পুষ্টি উপাদান অপরিহার্য।
- মস্তিষ্কের বিকাশ ও স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, আয়োডিন, জিংক, বি ভিটামিনসমূহ এবং আয়রন শিশুর স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও শেখার ক্ষমতা বাড়ায়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ: ভিটামিন এ, সি, ই, জিংক এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে গুরুতর সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
- শক্তি সরবরাহ ও কর্মক্ষমতা নিশ্চিতকরণ: দৈনন্দিন খেলাধুলা, পড়ালেখা ও বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত শক্তি (ক্যালরি) দরকার, যা আসে শর্করা (কার্বোহাইড্রেট) এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি থেকে।
- ভবিষ্যতের সুস্থ অভ্যাস গড়ে তোলা: শৈশবে গড়ে ওঠা খাদ্যাভ্যাস প্রাপ্তবয়স্ক জীবনেও টিকে থাকে। স্বাস্থ্যকর খাওয়ার অভ্যাস ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমায়।
বয়সভিত্তিক শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা: বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে ব্যবহারিক দিকনির্দেশনা
একটি ‘এক সাইজ ফিটস অল’ অ্যাপ্রোচ শিশু পুষ্টিতে কাজ করে না। দুধপোষ্য শিশুর চাহিদা আর স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীর চাহিদা সম্পূর্ণ আলাদা। আসুন দেখে নিই বয়স অনুযায়ী কী কী এবং কতটুকু খাবার দিতে হবে:
১. ৬ মাস থেকে ১ বছর: কঠিন খাবারে পদার্পণ (Weaning Foods)
- মূল নীতি: শুধু মায়ের দুধ বা ফরমুলা দুধই প্রধান খাবার। ধীরে ধীরে অর্ধকঠিন ও কঠিন খাবারের সাথে পরিচয় করানো। একবারে একটিমাত্র নতুন খাবার শুরু করুন (৩-৪ দিন পরপর নতুন খাবার যোগ করুন), অ্যালার্জি লক্ষ্য করুন। খুব নরম ও পিউরি আকারে খাবার দিন। লবণ/চিনি একদম নয়।
- প্রস্তাবিত শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা (দৈনিক):
- শস্য: চালের গুঁড়ার পাতলা জাউ (অতিথি), সুজি/সেমাইয়ের হাল্কা খিচুড়ি। পরে ভাত খুব নরম করে মেখে।
- শাকসবজি: সেদ্ধ ও পিউরি করা গাজর, মিষ্টিকুমড়া, আলু, পেঁপে, পালংশাক (সাবধানে, অল্প করে শুরু করুন)।
- ফল: পাকা কলার থেঁতো অংশ, পাকা পেঁপে থেঁতো, আপেল/নাশপাতি সিদ্ধ ও পিউরি।
- প্রোটিন: সেদ্ধ ডাল (মসুর বা মুগ) খুব পাতলা করে, পরে মাছের কাঁটা ছাড়া মাংস (চিংড়ি, পুঁটি, ট্যাংরা) থেঁতো করে। ডিমের কুসুম সেদ্ধ থেঁতো করে (সাদা অংশ ১ বছর পর)।
- চর্বি: অল্প পরিমাণে ঘি বা তেল (সরিষা/সয়াবিন) খিচুড়িতে মেশানো।
- পরিমাণ: শুরুতে ১-২ চা চামচ করে, ধীরে ধীরে বাড়িয়ে ১ বাটির ১/৩ ভাগ পর্যন্ত। মায়ের দুধ/ফরমুলা চালিয়ে যান।
- বাংলাদেশি টিপস: দেশি ফল-সবজি ব্যবহার করুন। বাড়িতে তৈরি খাবার সবচেয়ে ভালো। বাজারের প্যাকেটজাত শিশুখাবারে চিনি/লবণ/প্রিজারভেটিভ থাকতে পারে।
২. ১ বছর থেকে ৩ বছর: সক্রিয় অন্বেষণ ও স্বাদ বিকাশ (Toddlers)
- মূল নীতি: পরিবারের সাথে টেবিলে বসে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। খাবারের টেক্সচার বাড়ান (নরম কাটা, ছোট টুকরা)। হাত দিয়ে খেতে উৎসাহিত করুন (মেসি হবে, কিন্তু জরুরি!)। স্বাদ বিকাশের সোনালী সময় – বিভিন্ন রকমের খাবার চিনতে দিন। দুধ (৩-৪ কাপ) ও পানি গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রস্তাবিত শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা (দৈনিক):
- শস্য: ভাত, রুটি, সুজি/সেমাইয়ের উপমা/খিচুড়ি, ওটস – ৩-৪ সার্ভিং (১ সার্ভিং = ১/২ কাপ ভাত/ ১টি মাঝারি রুটি)।
- শাকসবজি: নানা রঙের শাকসবজি (লাল-সবুজ-কমলা) – ১ কাপ (কাটা/সিদ্ধ/তরকারি)।
- ফল: মৌসুমি ফল (আম, কলা, পেয়ারা, পেঁপে, কমলা, মাল্টা) – ১ কাপ (টুকরা করা)।
- প্রোটিন:
- ডাল/শিম জাতীয় – ১/৪ – ১/২ কাপ।
- মাছ/মুরগি/গোশত (কাঁটা/হাড় ছাড়া, ছোট টুকরা) – ৩০-৬০ গ্রাম।
- ডিম – ১ টি।
- দুধ/দই – ২ কাপ।
- চর্বি: স্বাস্থ্যকর তেল (সরিষা, সয়াবিন, রাইস ব্র্যান), ঘি, বাদাম বাটার (অল্প, অ্যালার্জি সতর্কতা সহ) – সামান্য পরিমাণে রান্নায় বা মিশিয়ে।
- পরিমাণ: শিশুর ক্ষুধার্ত্ত অনুযায়ী দিন। জোর করবেন না। ছোট প্লেটে ছোট ছোট অংশ দিন।
- বাংলাদেশি টিপস: দেশি মাছ (ইলিশ, রুই, কাতলা, পুঁটির ছোট মাছ – ক্যালসিয়ামে ভরপুর) উৎকৃষ্ট প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামের উৎস। ছোট মাছ কাঁটাসহ থেঁতো করে দিতে পারেন। দেশি ফল-সবজির প্রাচুর্য কাজে লাগান।
৩. ৪ বছর থেকে ৮ বছর: স্কুল ও শেখার জগতে প্রবেশ (Pre-school & Early School)
- মূল নীতি: স্কুলের রুটিন ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপের চাহিদা মেটাতে শক্তির জোগান দিতে হবে। স্বাস্থ্যকর টিফিন ও স্ন্যাকসের গুরুত্ব অপরিসীম। পানিশূন্যতা রোধে পানি খাওয়ার অভ্যাস গড়ুন। খাবারে রঙিন শাকসবজি ও ফলের ভূমিকা বাড়ান।
- প্রস্তাবিত শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা (দৈনিক):
- শস্য: ভাত, রুটি, পরোটা (সামান্য তেলে), খিচুড়ি, ওটস, কর্নফ্লেক্স (চিনি কম) – ৪-৫ সার্ভিং (১ সার্ভিং = ১ কাপ ভাত/ ১টি রুটি/ ১/২ কাপ ওটস)। অর্ধেকের বেশি হোল গ্রেইন (লাল আটা/চাল, ওটস) হওয়া ভালো।
- শাকসবজি: বিভিন্ন ধরনের ও রঙের – ১.৫ – ২ কাপ (কাঁচা সালাদ, সিদ্ধ, রান্না)।
- ফল: মৌসুমি ও রঙিন ফল – ১.৫ কাপ (টুকরা বা পুরো ফল)।
- প্রোটিন:
- ডাল/শিম/ছোলা – ১/২ – ৩/৪ কাপ।
- মাছ/মুরগি/গোশত (কাটা, গ্রিলড/বেকড/স্টিউড) – ৬০-৯০ গ্রাম।
- ডিম – ১ টি।
- দুধ/দই/পনির/ছানা – ২.৫ কাপ সমতুল্য।
- চর্বি: রান্নায় ও স্ন্যাক্সে স্বাস্থ্যকর তেল/ঘি। বাদাম, বীজ (চিয়া, ফ্ল্যাক্স) অল্প পরিমাণে।
- টিফিন আইডিয়া (বাংলাদেশি): সবজি স্যান্ডউইচ (লাল আটার ব্রেড), ডিম পোচ/সিদ্ধ, ছোট মাছের চপ (বেকড), মুরগির গ্রিল, ফল (আপেল/কলা/পেয়ারা), দই, ছোলা ভাজা (অল্প তেলে), মুড়ি-চিড়া (সঙ্গে কলা/দই)। জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন: চিপস, চকলেট, কেক, পেস্ট্রি, প্যাকেট জুস নয়।
- স্ন্যাকস: ফল, দই, বাদাম (সতর্কতা), মুড়ি, ঘরে বানানো পপকর্ন (কম লবণ/মাখন), দুধ-কলা।
৪. ৯ বছর থেকে ১৩ বছর: কৈশোরে পদার্পণ ও দ্রুত বৃদ্ধি (Pre-teens & Early Teens)
- মূল নীতি: বয়ঃসন্ধির দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পুষ্টির চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিশেষ করে মেয়েদের আয়রন, ছেলেদের প্রোটিন ও দুপুরের চাহিদা বাড়ে। হাড়ের ঘনত্ব গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিয়ার প্রেশার ও স্কুলের চাপে অস্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে ঝুঁকতে পারে।
- প্রস্তাবিত শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা (দৈনিক):
- শস্য: ৫-৬ সার্ভিং, হোল গ্রেইনের উপর জোর (লাল আটা/চাল, ওটমিল, বার্লি)।
- শাকসবজি: ২ – ২.৫ কাপ (অর্ধেক পাতাজাতীয় ও কমলার শাকসবজি)।
- ফল: ২ কাপ।
- প্রোটিন:
- ডাল/শিম/ছোলা/সয়াবিন – ১ কাপ রান্না করা।
- মাছ/মুরগি/গোশত/ডিম – ১২০-১৫০ গ্রাম (মেয়েদের আয়রনের জন্য লাল মাংস/মাছ/ডিম/শাক গুরুত্বপূর্ণ)।
- দুগ্ধজাত: ৩ কাপ সমতুল্য (দুধ, দই, পনির, ছানা)। ক্যালসিয়ামের চাবিকাঠি!
- চর্বি: স্বাস্থ্যকর উৎস (অ্যাভোকাডো, বাদাম, বীজ, তেল) থেকে মাঝারি পরিমাণ।
- বিশেষ গুরুত্ব:
- আয়রন: সবুজ শাক, পালংশাক, কলমি শাক, ডালিম, লাল মাংস, কলিজা (অল্প), মাছ, ডিম। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার (লেবু, আমলকী, পেয়ারা, টমেটো) এর সঙ্গে খেলে আয়রন শোষণ বাড়ে।
- ক্যালসিয়াম: দুধ, দই, পনির, ছানা, ছোট মাছ (কাঁটাসহ), তিল, বাদাম।
- ভিটামিন ডি: সূর্যের আলো (সকাল ১০টা-বিকেল ৩টা), ডিমের কুসুম, ফ্যাটি ফিশ (স্যামন, ইলিশ), ফর্টিফায়েড দুধ (যদি পাওয়া যায়)।
- চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা: পিয়ার প্রেশার ও বিজ্ঞাপনের প্রভাবে জাঙ্ক ফুডের আকর্ষণ বেশি। স্বাস্থ্যকর বিকল্প তৈরি করুন (হোমমেড বার্গার, বেকড চিকেন ফ্রাই, ফ্রুট সালাদ)। খাবারে অংশগ্রহণ করতে দিন।
বাংলাদেশি রান্নাঘর থেকে স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু বিকল্প: জাঙ্ক ফুডের জায়গায় কী দেবেন?
শিশুরা প্রায়ই চায় চিপস, চকলেট, নুডুলস, কোল্ড ড্রিংক। এই অস্বাস্থ্যকর পছন্দগুলোর জন্য তৈরি করুন মজাদার ও পুষ্টিকর বিকল্প:
- চিপস/ক্র্যাকারের পরিবর্তে:
- মুড়ি বা চিড়া: অল্প তেলে ভাজা মুড়ি বা চিড়া। সঙ্গে দই বা কলা মিশিয়ে দিতে পারেন।
- ঘরে বানানো পপকর্ন: সামান্য তেলে পপকর্ন বানিয়ে অল্প লবণ বা চাট মসলা ছড়িয়ে দিন।
- খই (Puffed Rice): বিভিন্ন রকমের খই (চালের, যবের)।
- বেকড সবজি চিপস: কুমড়া, মিষ্টি আলু, বিটরুট পাতলা করে কেটে অলিভ অয়েল ও সামান্য লবণ মাখিয়ে বেক করে নিন।
- মুরালি/মুড়ি ভাজা (Puffed Snacks): চাল/ডালের গুঁড়া দিয়ে বাড়িতে হালকা করে ভেজে নিন।
- চকলেট/ক্যান্ডির পরিবর্তে:
- তাজা বা শুকনো ফল: খেজুর, কিশমিশ, অ্যাপ্রিকট, আমসত্ত্ব, কলা চিপস।
- দুধ/দই দিয়ে তৈরি মিষ্টি: ছানা/পনিরের মিষ্টি, দই-চিড়া-গুড়, দুধ-সেমাই (চিনি কম), ফলের সালাদ।
- ডার্ক চকলেট (৭০%+ কোকো): অল্প পরিমাণে (১-২ স্কোয়ার) দিতে পারেন।
- নুডুলস/ফাস্ট ফুডের পরিবর্তে:
- সবজি খিচুড়ি/পোলাও: প্রচুর সবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি বা পোলাও।
- স্প্রাউটস স্যালাড: বিভিন্ন ডালের অঙ্কুরিত বীজ, শসা, টমেটো, গাজর কুচি, লেবুর রস ও সামান্য লবণ দিয়ে।
- সবজি স্যান্ডউইচ/রোল: লাল আটার ব্রেড বা পরোটায় সবজি (গাজর, শসা, লেটুস, টমেটো) ও ডিম/মুরগির গ্রিল/ছানা ভর্তা দিয়ে।
- হোমমেড বার্গার: লাল আটার বান, ভেতরে সবজি ও মুরগির কিমা/ছোলার কাটলেট (বেকড/শুভ্রা তেলে ভাজা)।
- কোল্ড ড্রিংক/প্যাকেট জুসের পরিবর্তে:
- তাজা ফলের রস (সবজি মিশিয়েও): পানি কম দিয়ে ব্লেন্ড করে, চিনি ছাড়া।
- লাচ্ছি/স্মুদি: দই/দুধের সাথে ফল মিশিয়ে।
- ডাবের পানি: প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইটের উৎস।
- লেবুর পানি/বেলের শরবত: চিনি কম দিয়ে।
- সরল পানি: সবচেয়ে ভালো! রঙিন বোতলে বা স্ট্র দিয়ে দিলে শিশুরা আগ্রহ পেতে পারে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা: যখন শিশু খেতে চায় না বা পছন্দ করে না
- ধৈর্য ধরুন: নতুন খাবার চিনতে ১০-১৫ বার চেষ্টা লাগতে পারে। জোর করবেন না, তবে হাল ছাড়বেন না। ছোট ছোট অংশে দিন।
- খেলার ছলে আনুন: খাবারকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজান। ফল-সবজি দিয়ে মজার চেহারা বানান। রঙিন প্লেট ব্যবহার করুন।
- শিশুকে যুক্ত করুন: বাজার করুন একসাথে, রান্নায় সহজ কাজে সাহায্য করতে দিন (ধোয়া, মেশানো)। নিজেরা যেটা বানাবে, সেটা খেতেও আগ্রহ পাবে।
- রোল মডেল হোন: আপনি নিজে স্বাস্থ্যকর খাবার খান, শিশু দেখে শিখবে।
- নিয়মিত সময় মেনে চলুন: নির্দিষ্ট সময়ে খাবার ও স্ন্যাকস দিন। খাবারের মাঝে জুস/দুধ বেশি দিলে ক্ষুধা কমে যাবে।
- বিকল্প বাছাই করুন: একই পুষ্টি অন্য উৎস থেকে দিন। মাছ না খেলে ডিম/দুধ/ডাল। দুধ না খেলে দই/পনির/ছানা।
- বাস্তবতা মানুন: সব খাবার সবসময় পছন্দ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কয়েকটি স্বাস্থ্যকর খাবার নিয়মিত খেলেই হলো।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: ডা. ফারহানা রহমানের (শিশু পুষ্টিবিদ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল) মতামত
“বাংলাদেশে শিশু পুষ্টির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ‘ডাবল বার্ডেন’ – একদিকে অপুষ্টি, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান স্থূলতা ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি। এর মূল কারণ প্রক্রিয়াজাত খাবার ও চিনিযুক্ত পানীয়ের অত্যধিক ব্যবহার এবং শাকসবজি-ফল-দুগ্ধজাত খাবারের ঘাটতি। মা-বাবাদের জন্য আমার পরামর্শ:
- জন্মের পর ৬ মাস শুধু মায়ের দুধ দিন।
- ৬ মাস পর থেকে বাড়িতে তৈরি, তাজা ও প্রাকৃতিক খাবারের সাথে ধীরে ধীরে পরিচয় করান। লবণ ও চিনি এড়িয়ে চলুন।
- খাবারে বৈচিত্র্য আনুন। ‘রেইনবো প্লেট’ (বিভিন্ন রঙের ফল-সবজি) লক্ষ্য করুন।
- জাঙ্ক ফুডকে ‘কদাচিৎ’ (occasional) খাবার হিসেবে গড়ে তুলুন, নিয়মিত নয়।
- সক্রিয় জীবনযাপনে উৎসাহিত করুন। স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন।
সরকারি নির্দেশনা ও আইসিডিডিআর,বির গবেষণা সবসময় স্থানীয় ও সহজলভ্য খাবারের উপর জোর দেয়। দেশি মাছ, ডাল, সবুজ শাক, মৌসুমি ফল – এগুলোই আমাদের সোনালী সম্পদ।”
জেনে রাখুন-
প্রশ্ন: বাচ্চারা শাকসবজি একদমই খেতে চায় না, কী করব?
- উত্তর: হতাশ হবেন না। খুব ছোট ছোট টুকরা করে অন্য প্রিয় খাবারের (ভাত, খিচুড়ি, ডিমভাজি) সাথে মিশিয়ে দিন। সবজির স্যুপ বা ডালে ব্লেন্ড করে মেশাতে পারেন। সবজি দিয়ে মজার শেপ বানান (ফুলকপির ‘ট্রি’, গাজরের ‘স্টিক’)। রান্নায় শিশুকেও অংশ নিতে দিন। ধৈর্য্য ধরে বারবার চেষ্টা করুন। একবারে একটিমাত্র নতুন সবজি চালু করুন।
- প্রশ্ন: হাড় ও দাঁত শক্তিশালী করার জন্য শিশুদের খাবারে কী রাখা জরুরি?
উত্তর: ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি হাড়ের প্রধান বন্ধু। ক্যালসিয়ামের জন্য দুধ, দই, পনির, ছানা, ছোট মাছ (কাঁটাসহ), তিল, বাদাম, সবুজ শাক (পালং, কলমি) দিন। ভিটামিন ডি-এর জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে হাত-পায়ে ১৫-২০ মিনিট রোদ লাগান। ডিমের কুসুম ও ফ্যাটি ফিশ (ইলিশ, রূপচাঁদা) ভিটামিন ডি-এর উৎস। অনেকসময় চিকিৎসকের পরামর্শে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট দরকার হয়। - প্রশ্ন: বাচ্চারা বার বার জাঙ্ক ফুড চায়, স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে কী দিতে পারি?
উত্তর: জাঙ্ক ফুডকে ‘নিষিদ্ধ’ না করে ‘কদাচিৎ’ খাবার হিসেবে গড়ে তুলুন। ঘরে বানানো সুস্বাদু বিকল্প তৈরি করুন: বেকড চিকেন ফ্রাই বা ফিশ ফিঙ্গার, সবজি চপ (ওভেনে বেকড), হোমমেড পিজা (লাল আটার বেস, প্রচুর সবজি), ফ্রুট সালাদ, বাদাম-মুড়ির মিক্স, দই-চিড়া-ফল। খাবারের নামে মজার নাম দিন (‘সুপারহিরো স্যান্ডউইচ’, ‘রেইনবো সালাদ’)। - প্রশ্ন: আমার শিশুর খাবারে খুব অরুচি, ওজনও ঠিকঠাক বাড়ছে না, কী করব?
উত্তর: প্রথমে কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। ক্লান্তি? জ্বর? মানসিক চাপ? কৃমি? খাবারের সময়ের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ও আনন্দদায়ক রাখুন। জোর করবেন না। ছোট ছোট কিন্তু ঘন ঘন পুষ্টিকর খাবার ও স্ন্যাকস দিন (২-৩ ঘণ্টা পর পর)। পছন্দের স্বাস্থ্যকর খাবার বেশি রাখুন। খাবারের রুটিন ঠিক করুন। যদি ওজন না বাড়ে বা দুর্বলতা দেখা দেয়, অবশ্যই একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন। - প্রশ্ন: স্কুলে টিফিনে কোন কোন স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে পারি যা সহজে নষ্ট হবে না?
উত্তর: * সবজি স্যান্ডউইচ/রোল (লাল আটার ব্রেড/পরোটা)।- ডিম সিদ্ধ বা ডিম পোচ।
- ছোট মাছ/মুরগির গ্রিল (ভালো করে রান্না করে ঠাণ্ডা করে দিন)।
- ফল (আপেল, কলা, পেয়ারা, আঙুর)।
- দই (ছোট টিফিন বক্সে)।
- ছোলা ভুনা/সিদ্ধ (অল্প মসলায়)।
- মুড়ি/চিড়া (প্লাস্টিকে এয়ারটাইট রাখুন) সাথে ছোট প্যাকেটে দই বা কলা আলাদা।
- ঘরে বানানো কেক বা মuffিন (সবজি বা ফল দিয়ে, চিনি কম)। পানির বোতল ভুলবেন না!
- প্রশ্ন: শিশুদের মিষ্টি খাবার (চিনি) কতটুকু দেওয়া যাবে?
উত্তর: চিনি যত কম, তত ভালো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু উভয়ের জন্য চিনির গ্রহণ দৈনিক মোট ক্যালরির ১০%-এর কম হওয়া উচিত (আদর্শ ৫% বা ~৬ চা চামচের কম)। শিশুদের জন্য আরও কম। চিনি, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংক, প্যাকেট জুস, ক্যান্ডি, কুকিজ, কেক, পেস্ট্রি – এগুলোতে ‘ফ্রি সুগার’ থাকে যা দাঁতের ক্ষতি, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। মিষ্টির চাহিদা মেটাতে তাজা ফল, দুধের তৈরি বাড়ির মিষ্টি (চিনি কম) দিন।
শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা শুধু একটি কাগজে লেখা তালিকা নয়; এটি আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা যে উজ্জ্বল, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী ভবিষ্যত কামনা করি, তারই রোডম্যাপ। প্রতিটি সুষম খাবার, প্রতিটি তাজা ফল বা সবজির কামড়, প্রতিটি গ্লাস দুধ – এসবই তাদের দেহকোষে শক্তি জোগায়, হাড় গড়ে, মস্তিষ্কের স্নায়ুপথে নতুন সংযোগ তৈরি করে। বাংলাদেশি রান্নাঘরের সহজলভ্য উপাদান – দেশি মাছ, ডাল, শাক-সবজি, মৌসুমি ফল, দুধ-দই – এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই অমূল্য পুষ্টির ভাণ্ডার। জাঙ্ক ফুডের মোহনীয় কিন্তু ধ্বংসাত্মক আকর্ষণকে ‘না’ বলতে হবে, ধৈর্য্য ধরে তাদের স্বাস্থ্যকর স্বাদের জগতে পরিচয় করাতে হবে। মনে রাখবেন, আজকের আপনার এই সচেতন প্রচেষ্টাই আগামী দিনের একটি সুস্থ, সক্ষম ও প্রাণবন্ত প্রজন্ম গড়ে তুলবে। শুরু করুন আজই – আপনার শিশুর প্লেটে রংধনুর ছটা আনুন, তাদের জীবনের ভিত্তিকে করুন আরও মজবুত ও উজ্জ্বল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।