জুমবাংলা ডেস্ক : গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নিজমাওনা গ্রাম। এই গ্রামের বিএনপি বাজার এলাকার আশপাশে যত দূর চোখ যায়, শুধু সাইনবোর্ড আর সাইনবোর্ড। পতিত জমি, সরকারি জমি, জঙ্গল কিংবা আবাদি জমি—সবখানেই সাইনবোর্ডে এক ব্যক্তির নাম, ডা. ইকবাল। তবে এলাকাবাসী বলছেন, চিকিৎসকের নামে কেনা হলেও জমিগুলো পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের হতে পারে।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেনজীর আহমেদের সম্পদ অনুসন্ধানে নামার পর এসব জমির মালিকানা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর গত রোববার রাতে সব জমির সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়।
চিকিৎসক ইকবালের পুরো নাম খালেদ মোহাম্মদ ইকবাল। তাঁর বাড়িও নিজমাওনা গ্রামে। তাঁর বাবা গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত ইসমাইল হোসেন। ইকবাল পুলিশ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তিনি বেনজীর আহমেদের ব্যক্তিগত চিকিৎসকও ছিলেন।
ইকবালের বাবা এলাকার প্রভাবশালী চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই সূত্রে ছেলেরও এলাকায় প্রভাব রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় প্রায় ২৫০ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। দখল করেছেন সরকারি জমি। পছন্দের জমি কিনতে এলাকাবাসীকে উচ্ছেদ করেছেন।
তবে দুদক বেনজীর আহমেদের সম্পদ অনুসন্ধানে নামার পর খানিকটা বিপাকে পড়েছেন চিকিৎসক ইকবাল। রোববার রাতে জমিগুলো থেকে সাইনবোর্ড সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সাইনবোর্ডের স্থানে গাছ লাগানো হয়েছে।
সম্প্রতি নিজমাওনা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এখানে কমপক্ষে ১৫ স্পটে চিকিৎসক ইকবালের নামে সাইনবোর্ড ঝুলছে। নিজমাওনা গ্রামের রুহুল আমিন মাস্টারের বাড়ির পশ্চিম পাশে ৩৫ বিঘা জমি, একই গ্রামের মৃত আব্দুল কাদির পীরের আশপাশের ২০ বিঘা, মৃত আহমেদ আলীর ছেলে তাজউদ্দিনের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে চিংড়ির খাল পর্যন্ত ৫০ বিঘা, মধ্য নিজমাওনার আমিনুল ইসলাম মাস্টারের বাড়ির পাশে ৫০ বিঘা, নিজমাওনা গ্রামের পুটিমারা বাজারের পশ্চিম পাশে সালদহ নদের পাশে ১৫ বিঘা, নিজমাওনা বড়চালা বাজারের দক্ষিণ পাশে ২৫ বিঘা। এ ছাড়া গাজীপুর মৌজার ৮১৫ নম্বর এসএ দাগের কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমিতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছিলেন তিনি।
এর বাইরে এলাকার ইসমাইলের মোড়ের পশ্চিম পাশে আলিশান বাড়িসহ কমপক্ষে ১০ বিঘা জমিতে তাঁর নামে সাইনবোর্ড ছিল। চিকিৎসক ইকবাল ছাড়াও ডা. জামান, মাসুদ করিম ও তৌহিদুন্নাহার চৌধুরীর নামেও এসব এলাকায় সাইনবোর্ড ছিল।
শ্রীপুরের সাবরেজিস্ট্রার মো. ওসমান গনি মণ্ডল বলেন, ‘আমি এই অফিসে যোগদানের পর চিকিৎসক ইকবালের নামে ২০ থেকে ২৫ বিঘা জমি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় আমরা দলিল যাচাই-বাছাই করছি। এখানে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের নামে বা তাঁর কোনো স্বজনদের নামে কোনো দলিল হয়নি।’
এদিকে সরকারি জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাওনা ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহাব। তাঁর মতে, গাজীপুর মৌজার ৮১৫ নম্বর এসএ দাগের সরকারি জমির পরিমাণ ১৮৬ একর। এসব থেকে কিছু জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। জমিতে সাইনবোর্ড দিয়ে মালিকানা দাবি করলেও ১ শতাংশ জমির নামজারি খারিজ দেওয়ার সুযোগ নেই।
নিজমাওনায় যেতেন বেনজীর
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দিনমজুর বলেন, ‘আট মাস আগে বেনজীর আহমেদ আমাদের এলাকায় এসেছিলেন। এ সময় তিনি আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন খুলে গল্প করেছেন। তিনি মাঝেমধ্যে আমাদের এই এলাকায় আসতেন। এই এলাকার বেশির ভাগ জমি তিনি কিনে নিয়েছেন। তবে সাইনবোর্ডে নাম আছে ইকবালের।’
নিজমাওনা গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, বেনজীর আহমেদ ও চিকিৎসক ইকবালের হয়ে জমি কিনে দিয়েছেন গ্রামের তাজুল ইসলাম, আইনুদ্দিন, মাসুদ মেকার, তৌহিজ উদ্দিন তহু ও আয়ুব আলী। এই জমিগুলো দেখাশোনার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। যাঁরা এসব জমি পাহারা দিতেন, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর তাঁরাও আর এলাকায় নেই।
বাড়ি ছাড়তে হয়েছে অনেককে
জমি কিনতে গিয়ে জবরদখলের ঘটনাও ঘটেছে শ্রীপুরের এই গ্রামে। অনেকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এমনই এক ভুক্তভোগী সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের স্ত্রী বলেন, ‘হঠাৎ করে একদিন স্থানীয় বাসিন্দা তাজউদ্দিন এসে জানান, এই বাড়ি ভেঙে চলে যেতে হবে। এরপর তাঁরা আমাদের বাড়ির চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেন। পরে বাধ্য হয়ে আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। তাঁদের ভয়ে মুখ খুলতে পারি না। আমরা অসহায় মানুষ।’
এ প্রসঙ্গে আরেক কৃষক বলেন, ‘শত শত বিঘা জমিতে ডা. ইকবালের নামে সাইনবোর্ড। ঘুরে দেখেন, অসংখ্য ঘরবাড়ি পরিত্যক্ত পাবেন। এগুলো থেকে মানুষ চলে গেছেন। এমনিতে যাননি, কীভাবে গেছেন খোঁজখবর নেন, তাহলে বুঝবেন। তিনি সরকারি জমি জবরদখলে নিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন। আরও কত ঘটনা, সব জানতে পারবেন।’
এসব বিষয়ে জানতে চিকিৎসক ইকবালের মোবাইলে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।