জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) পরীক্ষাসহ গত ২২ বছরে ৩০টি সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে সাম্প্রতিক সময়ে দেশ জুড়ে আলোচিত ‘আবেদ আলী চক্র’। সিআইডির হাতে আটক ১৭ জন এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তবে প্রকৃতপক্ষে তারা অর্ধশতাধিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন বলে ধারণা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে গ্রেফতারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী, প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের কাছ থেকে ব্যাংকের ৫৮টি চেক উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি ‘ব্ল্যাংক চেক’। বাকি ৪৭ চেকে সাড়ে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
একই সঙ্গে আরো ১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পিএসসির আরো পাঁচ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, তারা পলাতক। এর মধ্যে সিস্টেম অ্যানালিস্ট রয়েছেন এক জন। তার নাম উজ্জ্বল। এদেরকে গ্রেফতারে সিআইডি বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। জানা গেছে, প্রশ্ন ফাঁস চক্রের গডফাদাররা অনেক প্রভাবশালী। পিএসসি ছাড়াও এর সঙ্গে সংঘবদ্ধ বিশাল একটি গ্রুপও রয়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক দেশব্যাপী বিস্তৃত। প্রশ্ন ফাঁস চক্রের গডফাদারদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে সিআইডি।
সূত্র জানায়, পিএসসির সাবেক মেম্বার মাহফুজুর রহমানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী (৫২) জড়িত ছিলেন নগদ লেনদেন ও চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহের কাজে। পিএসসির ডেসপাস রাইটার সাজেদুল ইসলামকে (৪১) আগেই ১০ কোটি টাকার চেকসহ আটক করা হয়েছিল। তার দেওয়া তথ্যে উঠে আসে চক্রের মূলহোতা হিসেবে কাজ করতেন সৈয়দ আবেদ আলী। সাজেদুল জানান, সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশী সংগ্রহ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে চক্রের অন্যতম সদস্য সৈয়দ আবেদ আলীর কাছে রেলওয়ের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর বিতরণ করা হয়। প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য নোমান সিদ্দিকী (৪৪)। লক্ষ্মীপুর রামগতির বাসিন্দা নোমান থাকতেন রাজধানীর মিরপুর-১০ সেনপাড়া পর্বতা এলাকায়। তিনি আটক আছেন। একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে কয়েক শ কোটি টাকা দিয়েছেন। ডেভেলপার কোম্পানির মালিকসহ তিনি আটক আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা শুরু হয় ২০০২ সাল থেকে। আবেদ আলী ছাড়াও পিএসসির আরো অনেক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন ঐ কাজে। ঐ সময় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের থেকে একটি তালিকা তাদের কাছে যেত। তারা প্রশ্ন পত্র আগে থেকে পেয়ে পরীক্ষায় পাশ করে যেতেন। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রশ্নপত্র দিয়ে পাশ করানো হয়েছে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে। চক্রের অনেকে এখন পলাতক। পিএসসির সদস্য মাহফুজুর রহমান এ কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি ছাড়াও কোনো কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার নামও আসছে, যারা এখন চাকরিতে নেই। যারা আবেদ আলীর মতো প্রশ্ন ফাঁস চক্র তৈরি করেছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। গ্রেফতারকৃতরা যেসব মানুষের নাম বলেছেন, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। অনেক হাই প্রোফাইল মানুষের নাম রয়েছে এ তালিকায়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে চাকরি পেয়ে সচিবালয়সহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে তারা কর্মরত রয়েছেন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সিআইডির উচিত প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মধ্যে যারা এখনো পলাতক তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা। আর যারা গ্রেফতার আছেন, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগারে নেওয়া। দুদকের সাবেক এক জন কর্মকর্তা বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। কারণ তারা হলো দুর্নীতির কারিগর। প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগে গিয়ে তারা দুর্নীতি করে যাচ্ছে। তারা বলেন, আমাদের দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে প্রথম দিকে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে তদন্ত করা হয়। পরে আস্তে আস্তে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা যেন প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ক্ষেত্রে না ঘটে। সিআইডিকে আরো শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। জনসম্মুখে তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, অর্থের বিনিময়ে পাওয়া প্রশ্নে বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিরত প্রার্থীরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভাবমূর্তি ও আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। চাকরিপ্রার্থীসহ সাধারণ মানুষের একটি সহজ ধারণা হলো, বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়া ব্যক্তিরা সব পর্যায়ে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নিয়োগ পান। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রশ্ন ফাঁসের এ মহামারির খবর প্রকাশ পাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি তলানিতে নেমেছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুষ্ঠু তদন্ত, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, সর্বোপরি সর্বোচ্চ জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের।
৪৫০ জনকে প্রশ্নপত্র দিয়েছিলেন প্রিয়নাথ: ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের নাটের গুরু সৈয়দ আবেদ আলীর দোসর হলেন ঠাকুরগাঁওয়ের প্রিয়নাথ রায়। চাকরি দেওয়ার শর্তে একেক জনের সঙ্গে তিনি চুক্তি করতেন ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকায়। প্রায় ৪৫০ জনকে প্রশ্নপত্র দিয়ে চাকরি পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন তিনি। নিজের এলাকায় তেমন সম্পদ না থাকলেও দিনাজপুর ও ঢাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রিয়নাথের আছে বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি। প্রিয়নাথ চাকরিপ্রার্থীদের পৌঁছে দিতেন আবেদ আলীর কাছে। তাদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া হতো ২ থেকে ৫ লাখ টাকা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের রাইতু রায় ও রাজবালা দম্পতির সন্তান প্রিয়নাথ রায়। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা প্রিয়নাথ এসএসসি পরীক্ষার সময় হারান বাবাকে। এইচএসসির পরে বন বিভাগে চাকরি নেন তিনি। ডিগ্রি পাশ করে সেনাবাহিনীর অডিটর পদে যোগ দেন। এরপর তিনি জড়িয়ে পড়েন চাকরি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে। অপকর্মে ছেলের জড়িয়ে পড়ায় তার মা দায়ী করছেন পুত্রবধূকে। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে। বউয়ের বুদ্ধিতে সে চলে।
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম ফিরোজ ওয়াহিদ বলেন, চাকরি দেওয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় রয়েছে প্রিয়নাথের নামে একাধিক মামলা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সে বাড়িতে আসে না।
সূত্র : ইত্তেফাক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।