আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসারিয়া আনাল মেলি ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তার দাদার দেহাবশেষ খুঁজছেন। তার বিশ্বাস ১২৩ বছর আগে জার্মান ঔপনিবেশিক বাহিনী তার দাদা চাগা গোত্রের প্রধান মাঙ্গি মেলিসহ ১৮ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিল। পরে তার দাদার খুলি বার্লিনের একটি জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জার্মানদের হাতে তাঞ্জানিয়ায় নিহতদের অন্যান্য বংশধররাও দেহাবশেষের সন্ধান করছেন। সম্প্রতি ডিএনএ গবেষণার অভূতপূর্ব ব্যবহারে জাদুঘরে থাকা হাজার হাজার সংগ্রহের মধ্যে নিহতদের দুজনের খুলি শনাক্ত করা হয়েছে।
কিলিমাঞ্জারো পর্বতের নিচের ঢালে বাবলা গাছ পাওয়া বিরল। এর বাঁকানো শাখাগুলি খাড়া রাস্তার উপরে পৌঁছেছে এবং ঘন ঘন গাছপালাগুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এক সময়ে এটি সুদুনির গ্রামবাসীদের একটি বাজারকে ছায়া দিত, যাকে এখন বলা হয় ওল্ড মোশির একটি অংশ। কিন্তু সম্প্রদায়ের জন্য এই কেন্দ্রবিন্দু একটি বড় ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়েছিল।
১৯০০ সালের ২ মার্চ এখানেই ১৯ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জার্মান ঔপনিবেশিক বাহিনীকে আক্রমণ করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাদের দ্রুত বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল।
১৮৮৪-১৮৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনে আফ্রিকায় জার্মানির দাবির আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। ইউরোপীয় শক্তিগুলি আফ্রিকাকে তাদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল।
মাঙ্গি মেলি ১৮৯২ সালে জার্মান বাহিনীকে সফলভাবে পরাজিত করেছিলেন। সেই সাফল্যটি পরবর্তীতে পরাজয়ে রূপ নেয়। ১৯ শতকের শেষের দিকে পূর্ব আফ্রিকার এই অংশে জার্মানি তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। যারা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছে তাদের জন্য মাঙ্গি মেলি এবং অন্যান্য স্থানীয় নেতাদের শাস্তি দিয়ে একটি উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছিল জার্মান বাহিনী। তাঞ্জানিয়ার এই উপজাতি নেতাদের অপমান এখানেই শেষ হয়নি।
স্বাধীনতাকামী অনেক যোদ্ধাকেই সুদুনি গ্রামের বাবলা গাছের কাছাকাছি কোথাও একটি গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। তবে তাদের মাথাগুলো এক পর্যায়ে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরিয়ে ফেলেছিল জার্মানরা। এগুলো বস্তাবন্দী চার হাজার মাইল দূরে জার্মান রাজধানীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কঙ্কাল পাঠানো হয়েছিল।
মাঙ্গি মেলির স্ত্রী তার নাতিদের কাছে এ ঘটনার বিবরণ শুনিয়ে গেছেন। তিনি জানিয়েছেন, স্বামীকে ফাঁসিতে ঝুলানোর দৃশ্য তাকে দেখতে বাধ্য করেছিল জার্মান সেনারা।
দাদীর কাছে গল্প শুনে ১৯৬০ সাল থেকে ইসারিয়া আনাল জার্মানি ও তাঞ্জানিয়া কর্তৃপক্ষকে তার দাদার দেহাবশেষ খোঁজার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখে আসছেন। তবে কর্মকর্তারা তাকে এই বলে এড়ানোর চেষ্টা করেছিল যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রাসঙ্গিক রেকর্ডগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এতে দমে যাননি ইসারিয়া।
১৯ ও ২০ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার জাদুঘর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো মাথার খুলি এবং অন্যান্য মানব দেহাবশেষ সংগ্রহ করতে শুরু করে। কোনো জাতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মাথার খুলির আকারের মধ্যে প্রতিফলিত হয় ধারণার ওপর ভিত্তি করে গবেষণার অংশ হিসাবে এগুলো সংগ্রহ করা হতো। মূলত বর্ণবাদী ধ্যান-ধারণা থেকেই এ ধরনের গবেষণার উৎপত্তি। এর মাধ্যমে গবেষকরা একটি জাতিগত শ্রেণিবিন্যাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। ফলস্বরূপ ইউরোপীয়রা সারা বিশ্ব থেকে মাথার খুলি সংগ্রহ করতে শুরু করে। জার্মান নৃবিজ্ঞানী ফেলিক্স ফন লুসচান, যিনি বার্লিনের রয়েল মিউজিয়াম অব এথনোলজির আফ্রিকা ও ওশেনিয়া বিভাগের প্রধান ছিলেন, তিনি জার্মান সাম্রাজ্যের পাশাপাশি অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে দেহাবশেষ সংগ্রহে আগ্রহী ছিলেন।
পাঁচ দশক ধরে চেষ্টার পর মাঙ্গি মেলির নাতি ইসারিয়া ২০১০ সালে জানতে পারেন, বার্লিনভিত্তিক প্রুশিয়ান কালচারাল হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের কাছে ১৯ শতকে আফ্রিকা থেকে পাঠানো বহু মানুষের খুলি রয়েছে। এসব খুলির মধ্যে চাগা সম্প্রদায়ের মাত্র দুজনের খুলি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা গেছে। তবে এর মধ্যে মাঙ্গি মেলির খুলি নেই। অবশ্য ইসারিয়া এখনও হাল ছাড়েননি।
তার ভাষ্য, ‘মৃত্যুর আগে আমি আমার দাদাকে দেখে যেতে চাই।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।