মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব : যেভাবেই বলি না কেন। বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি নির্ভরশীল। নদী বিধৌত এ দেশের অধিকাংশ স্থান থাকে জলমগ্ন। বর্ষাকালে তো কথাই নেই, কেবল থৈ থৈ পানি আর পানি। তথ্যমতে জানা যায় যে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ অনেক জায়গায়ই হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল ও নদী-নালায় থাকে আচ্ছাদিত। এদিকে সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকা জোয়ারের পানিতে হয় প্লাবিত। ধান শালিকের এ দেশের সিংহভাগ এলাকা বছরের প্রায় ৭ মাস পানিবন্দিই থাকে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে জলমগ্ন থাকার কারণে কি কৃষি কাজ হয় না বা করা যাবে না? হ্যাঁ অবশ্যই করা যাবে। এ প্রেক্ষাপটে অন্যতম নিয়ামক ও আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাসমান সবজি (Floating Vegetables) চাষ। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, দক্ষিণাঞ্চলের নাজিরপুর, বানারীপাড়া, উজিরপুর, স্বরূপকাঠি, আগৈলঝাড়া প্রভৃতি উপজেলার বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে সবজি চাষ করে চলছে উল্লেখ্যযোগ্যসংখ্যক কৃষকরা। এখানে ঢেড়শ, চিচিঙ্গা, পেঁপে, লাউ, কুমড়া, শিম, বরবটি, টমেটো, বেগুন, করলা, ঝিঙ্গা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সবুজ কপি ইত্যাদির চারা উৎপাদনসহ কলমি শাক, কচু, পাট শাক, লাল শাক, লাউ শাক, পালং শাক, ডাটা শাকও চাষ করা হয়।
বর্ষা মৌসুমে এসব এলাকার হাজার হাজার হেক্টর নিচু জমি কচুরিপানা এবং অন্যান্য জলজউদ্ভিদসহ জলে বন্দি থাকে। কিন্তু জলাবদ্ধতা আর কচুরিপানা অভিশাপ হিসেবে মনে করা হলেও, এখন আর তা নয়। বাস্তবসম্মত কৌশলগত চাষের কারণে পরিণত হয়েছে আশীর্বাদে। তথ্যাদি অনুযায়ী, এই ভাসমান সবজি চাষের পথ চলা শুরু হয় নাজিরপুর থেকে এবং কালক্রমে ধীরে ধীরে এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, কমবেশি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
মজার ব্যাপার হলো যে, এর জনপ্রিয়তা ও আর্থিক দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্যতার সারণি ধরে বাংলাদেশের সবজি চাষকে স্বীকৃতি দিয়েছে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (জাতিসংঘ)। তাছাড়া ভাসমান আবাদ ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর গ্লোবাল এগ্রিকালচার হেরিটেজ সিস্টেম সাইট হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে জাতিসংঘ থেকে, যা কম কথা নয়?
এই চাষ সামনে রেখে আষাঢ় মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে স্তূপ করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে জলাভূমিতে কচুরিপানাসহ পর্যায়ক্রমে শ্যাওলা, দুলালীলতা, টোপাপানা, কুটিপানা, কলমিলতা ও নানা জলজ লতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে ২ থেকে ৩ ফুট পুরু করে ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। আর ধাপ দ্রুত পচানোর জন্যও সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ধাপ চাষের উপযোগী করতে ৭ থেকে ১০ দিন ধরে প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রাখতে হয়।
আর এভাবে সারা বছরের প্রয়োজনীয় জোগান নিশ্চিত করে রাখা হয়। একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০ থেকে ৬০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার প্রশস্ত এবং ১ মিটারের কাছাকাছি পুরু থাকে। এভাবে উঁচু বীজতলা তৈরি করে তার উপর কচুরিপানা ও বর্ণিত জলজ উদ্ভিদ স্তরে স্তরে সাজিয়ে নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া ও ক্ষুদ্রাকৃতির বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ পচিয়ে বীজতলার উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এখানে বীজ বপন করে উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির শাক-সবজি।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, ভাসমান (ধাপ) পদ্ধতিতে সরাসরি বীজ বপন করা সম্ভব হয় না বিধায় বীজ বপন করে চারা তৈরির জন্য পৃথক এক ধরনের আধার তৈরি করা হয়, যা স্থানীয় ভাষায় বলা হয় দৌলা বা মেদা। ভাসমান ধাপে স্বল্প জীবনকাল সংবলিত বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি চাষ করা হয়ে থাকে।
মূলত দক্ষিণ বাংলায় ভাসমান সবজি চাষের কার্যক্রম তুলনামূলক বেশি। এছাড়া গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া বর্নীর বিল, চান্দার বিল ও কোটালীপাড়ার বাইগ্যারবিলে এ পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। এতদ্ব্যতীত সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর ও নেত্রকোনার বিস্তৃত অঞ্চল তো রয়েছেই। শুধু তাই নয় সুদূর উত্তর বঙ্গেও এই চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথমদিকে কৃষকরা সন্দিহান থাকলেও এখন সফলতা আসায় সংশ্লিষ্ট সকল এলাকায় উৎসাহ অনেক বেড়ে গিয়েছে।
এদিকে গাইবান্ধাসহ উত্তরের আরও ১১টি জেলায় এই পদ্ধতিতে চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এনজিওদের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। বস্তুত ভাসমান সবজি চাষ বলতে গেলে রেঁনেসার ন্যায় দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য এক দশক আগে ভাসমান বেডে সবজি ও চারা উৎপাদন হতো মাত্র ৫০ থেকে ৭০ হাজার টন। এখন তা দেড় লাখ টন অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে বরিশাল ও পিরোজপুরের ‘মডেল’ দেশের ২৪টি জেলায় সম্প্রসারিত করা হয়েছে। কোনো এলাকা বন্যা কবলিত হলে, সেক্ষেত্রে সবজি ও চারার বড় অবলম্বন হলো ভাসমান চাষ পদ্ধতি।
ঢাকা রাজধানীর সমুদয় ছাদ বাগানের বাহারি চারার যোগান আসে এ এলাকা থেকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, দেশের ৪৫ লাখ হেক্টর স্থান জলসীমার মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ জমিতে যদি ভাসমান সবজির আবাদ করা যায়, তাহলে দেশের সবজি ও মসলা উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এদিকে পরিবর্তিত জলবায়ুর ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব ও সহায়ক হলো এই ভাসমান সবজি চাষ। তাছাড়া বন্যা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসেও তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
আর যদি সেইভাবে উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে এখনকার উৎপাদিত চারা আশপাশের দেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে। এই কারণে আগের অনাবাদি জমির মূল্য ও কদর বেড়েছে।
এ ব্যাপারে উল্লেখ্য যে সংশ্লিষ্ট চাষিরা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠার পাশাপাশি অন্যদেরও প্রকারান্তরে স্বাবলম্বী করার পথ খুলে দিয়েছেন। কেননা সবজি ও চারা কেনাবেচা এবং পরিবহনের সুবাদে কয়েক লাখ লোকের জীবিকার পথ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় সৌন্দর্যের দিক দিয়েও কম নয়। সারি সারি এসব ভাসমান ধাপের অপরূপ সৌন্দর্য বাঙালি মনে বাড়তি হিল্লোল বয়ে আনছে বললে অতুক্তি হবে না।
পরিশেষে বলতে চাই , এই পরিবেশবান্ধব ভাসমান সবজি প্রযুক্তি আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়ের দেশে সত্যি আশীর্বাদস্বরূপ এবং আগামী দিনের আলোক বর্তিকা। তাই এই পটেনশিয়াল কার্যক্রমকে আরও প্রসার এবং অর্থবহ করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ের লোকদের অংশীদারিত্বের আদলে বিভিন্ন আঙ্গিকে তৎপরসহ এগিয়ে আসতে হবে। সূত্র : জনকন্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।