জুমবাংলা ডেস্ক : যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে বর্তমান তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত লিডিয়ার রাজা ক্রোশাস প্রথমবারের মতো স্বর্ণকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে দামি এবং বহুল ব্যবহৃত ধাতু হিসেবে জায়গা করে আছে হলুদ বর্ণের এই ধাতুটি।
বর্তমান পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের কাছে স্বর্ণ হয়তো গহনার কাঁচামাল। খেলাধুলায় গোল্ড মেডেল কিংবা স্বর্ণের ট্রফি সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক। কিন্তু স্বর্ণ শুধু সাজসজ্জা কিংবা সম্মানের প্রতীক নয়, প্রতিটি দেশের অর্থনীতির সঙ্গে স্বর্ণের যোগসাজশ আরও নিবিড় এবং গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দীর্ঘ একটি সময় স্বর্ণের মজুতের ওপর ভিত্তি করে ডলারের বিপরীতে একটি দেশের মুদ্রার মান ঠিক করা হতো। বর্তমানে স্বর্ণের মজুতের ওপর মুদ্রার মান ঠিক করা না হলেও একটি দেশের স্বর্ণ আমদানি এবং রফতানির ওপর ভিত্তি করে সেই দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়।
স্বর্ণ কেন এত দামি?
লোহা, তামা, লেড, অ্যালুমিনিয়ামের মতো এত এত ধাতু থাকতে কেন স্বর্ণকে সবচেয়ে মূল্যবান ধাতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এটি অনেকেরই প্রশ্ন। যেখানে অন্যান্য ধাতু সহজেই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে সেখানে একদিকে স্বর্ণ দুষ্প্রাপ্য এবং অন্যদিকে টিকে থাকার ক্ষমতায় সর্বোচ্চ। কয়েক বছরে যেখানে লোহায় মরিচা ধরে, তামা পুরনো হয়ে যায়, সেখানে হাজার হাজার বছর ধরে স্বর্ণ কোনো রকম ক্ষয়প্রাপ্ত না হয়েই টিকে থাকতে সক্ষম।
মূলত প্রায় প্রতিটি ধাতু প্রকৃতিতে থাকা অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে, সেখানে স্বর্ণ সহজে কারও সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করে না কিংবা বিক্রিয়ার অংশ নিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারায় না। অন্যদিকে স্বর্ণ পরিবহন ও এটিকে যেকোনো আকৃতি দেয়া অন্যান্য ধাতুর থেকে সহজ। বলা হয়, মাত্র এক গ্রাম স্বর্ণ দিয়ে ১৬৫ মিটার লম্বা সুতা তৈরি করা সম্ভব। এ থেকে বোঝা যায় স্থিতিস্থাপকতার বিচারে স্বর্ণের অবস্থান সুউচ্চ।
এর বাইরে প্রাচীনকালে ধাতব মুদ্রা হিসেবে রুপার পাশাপাশি স্বর্ণের বহুল ব্যবহারের আরেকটি মূল কারণ ছিল এর নিম্ন গলনাঙ্ক। স্বর্ণ গলিয়ে সহজে একে মুদ্রায় রূপ দেয়া যায়। সেই থেকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত স্বর্ণ পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে গিয়ে ডলারের পরিপূরকে পরিণত হয়। সেসময় আমেরিকা প্রতি আউন্স স্বর্ণের বিপরীতে মুদ্রার মান নির্ধারণ করে ৩৫ ডলার।
এ ছাড়া বিশ্বে যেকোনো কিছুতে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকলেও স্বর্ণে বিনিয়োগে ঝুঁকি সবচেয়ে কম এবং একরকমের নেই বললেই চলে। গত বছর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন দেশে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন হওয়া শুরু করলে দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের স্বর্ণের মজুত বাড়ানো শুরু করে, কেননা মুদ্রার মান কমলেও স্বর্ণের মান কমে না। স্বর্ণ এমন এক ধাতু যা নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন নিজের গুণগত মান ধরে রাখতে সক্ষম, অন্যদিকে বাজারে নিজের আধিপত্যের ধারাও জারি রাখতে পারঙ্গম।
ডলার বনাম স্বর্ণ, কোনটা বেশি শক্তিশালী?
১৯৭১ সালে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড থেকে বের হয়ে আসার পর স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের মানের সরাসরি সম্পর্কে ছেদ ঘটলেও বর্তমান অর্থনীতিতে এখন পর্যন্ত স্বর্ণের আধিপত্য বহাল তবিয়তে বিরাজমান।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ জেফরি ফ্র্যাংকেল সংবাদমাধ্যম প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক কলামে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক যেকোনো সংকটে কোনো দেশকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যম হিসেবে ডলারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের নিত্য কার্যক্রম, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইরান এবং রাশিয়া। এখন পর্যন্ত ইরানের প্রায় দেড়শ বিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়ার সাড়ে পাঁচশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মুদ্রা যুক্ররাষ্ট্রের হাতে জব্দ।
এ ধরনের একাধিপত্য এবং আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্বের বাকি দেশগুলো মার্কিন ডলারের ওপর ভরসা হারাচ্ছে। এতে করে অনেক দেশ ইতোমধ্যে নিজেদের মুদ্রাব্যবস্থা এবং স্বর্ণের মজুতের ওপর জোর বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়ার নিজ মুদ্রা রুবল, ইরানের রিয়াল, চীনের ইউয়ান এবং ভারতের রুপিতে বাণিজ্য ডলারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ডলারের বিপরীতে অন্যান্য মুদ্রার দাম কমলেও ডলারের মান আসলে কখন কমে। মূলত প্রতি আউন্স স্বর্ণের বিপরীতে ডলারের পরিমাণ যখন বাড়তে থাকে তখন এর মূল মান কমতে থাকে।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণ ও ডলারের দামের অনুপাত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আউন্সপ্রতি মাত্র ৩৫ ডলার দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে আউন্সপ্রতি স্বর্ণের বিপরীতে মার্কিন মুদ্রার দাম ২ হাজার ডলার, যা স্মরণকালের সর্বোচ্চ। মূলত ডলারের ওপর আস্থা হারানোর কারণেই স্বর্ণের বিপরীতে এর দাম হয়েছে আকাশচুম্বী এমনটাই বলছেন ফ্র্যাংকেল।
একদশক আগেও যেখানে ডলারকে বলা হতো ‘সেইফ হেভেন’ মুদ্রা, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বিশ্ব এখন ডলারের বিকল্প খুঁজছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমারা রুশ তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলার বেঁধে দিলে, অনেকেই ধারণা করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন ডলারে নয়, এক ব্যারেলের বিপরীতে এক গ্রাম স্বর্ণ দিয়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করবেন। যদিও শেষমেশ এমনটা হয়নি, কিন্তু যখনই বিশ্ব বিকল্প কোনো মুদ্রার খোঁজ করেছে সেখানে ত্রাণকর্তা ও ভরসাস্থল হিসেবে সবসময় স্বর্ণকে বেছে নিয়েছে।
আবারও বাড়ছে স্বর্ণের মজুত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে নানা দেশের স্বর্ণের মজুত নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্ব বুঝতে পেরেছে ডলার তার আধিপত্য কিংবা ভরসাস্থল বজায় রাখতে পারুক না পারুক, মজুতকৃত স্বর্ণের পরিমাণই নির্ধারণ করবে আগামীর অর্থনীতি।
সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনভেসকো গ্লোবালের এক জরিপে দেখা যায়, ডলার সংকটের কারণে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। আর এই মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে বিভিন্ন দেশের ৬৮ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, স্বর্ণের মজুত বাড়াতে আগ্রহী তারা। মাত্র দুই বছর আগেও মজুতকৃত স্বর্ণের প্রতি আগ্রহী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিমাণ ছিল ৫০ শতাংশ, যা মাত্র তিন বছরে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
২০১৯ সালের ফোর্বসের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বর্ণের মজুতে বেশ কয়েক বছর ধরেই সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৮১৩৩ দশমিক ৫ টন স্বর্ণের মজুত রয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পরে তালিকায় থাকা তিনটি দেশের থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের মজুত প্রায় সমান কাতারে রয়েছে।
স্বর্ণের মজুতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে এবং মূল তালিকার দশম স্থানে আছে ভারতের নাম। সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে গৃহস্থালীতেই ভারতের মজুতকৃত স্বর্ণের পরিমাণ ২৩ হাজার থেকে ২৪ হাজার টন, যার বর্তমান বাজারমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
স্বর্ণ মজুতে বাংলাদেশের অবস্থান
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বর্ণ মজুতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৬তম। বর্তমানে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মোট ১৪ টন স্বর্ণ মজুত আছে, যা মোট রিজার্ভের প্রায় আড়াই শতাংশ।
তবে ২০২১-২২ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মজুতকৃত স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভোল্টে নয়, বরং ৪২ শতাংশ ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ভোল্টে এবং ৪১ শতাংশ লন্ডনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এইচএসবিসি ব্যাংকে রয়েছে।
মূলত দেশের রিজার্ভকে বহুমুখী করতে বাংলাদেশ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ১০ টন স্বর্ণ কেনে, যা পর্যায়ক্রমে বেড়ে ১৪ টনে পরিণত হয়েছে।
সুত্র : সময় নিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।