জুমবাংলা ডেস্ক : সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলার আটটি বিলের মাছ লুট করে নিয়ে গেছে স্থানীয় হাজারো লোকজন। মাইকে ঘোষণা দিয়ে এসব মাছ লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। গত পাঁচ দিনে দুই উপজেলার আটটি বিলের মাছ লুট করা হয়েছে। ইজারাদারদের দাবি, বিলগুলো থেকে অন্তত সাত কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে।
সবশেষ মঙ্গলবার শাল্লা উপজেলার কাশীপুর শতোয়া বিলের মাছ লুট করে নেওয়া হয়। স্থানীয় লোকজন জানান, বিলের মাছ লুটের ঘোষণা দিয়ে আগের দিন আশপাশের এলাকায় মাইকিং করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এসব বিল বিভিন্ন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি কাগজেপত্রে ইজারা নিলেও বাস্তবে এগুলো ভোগদখল করতেন দিরাই ও শাল্লার আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে এলাকার লোকজন বিল থেকে মাছ ধরার সুযোগ পেতেন না। গত ১৫ বছর ধরে সরকারের কাছ থেকে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ইজারা নিয়ে বিলগুলো থেকে মাছ মাছ বিক্রি করতেন। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে গেলে এলাকার লোকজন মাছ ধরার সুযোগ পান। গত পাঁচ দিনে বিলগুলো থেকে সব মাছ ধরে নিয়ে যান তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মঙ্গলবার সকালে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার অন্তত ১২টি গ্রামের প্রায় কয়েক হাজার লোকজন মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে বিলে নেমে পড়েন। তারা ইচ্ছেমতো মাছ লুট করে নিয়ে যান। এ সময় বিলের পাড়ে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা লুটপাটকারীদের বাধা দেয়নি। একই দিনে উপজেলার কাশীপুর গ্রামের কাছের বাইল্লা বিল ও ইয়ারাবাদ গ্রামের ভাটিগাং বিল লুটপাট করা হয়।
শতোয়া বিলের ইজারাদার উত্তর জারুলিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংগঠন। সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রজেশ দাস বলেন, এমন পরিস্থিতি জীবনেও দেখিনি। আমরা প্রতি বছর ৪৫ লাখ টাকা রাজস্ব দিই। তিন বছর পর পর মাছ ধরা হয়। আগামী বছর মাছ ধরার কথা থাকলেও এলাকার ১০-১৫ হাজার মানুষ দুই দিনে কোটি টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যায়। এতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাছ লুটপাট শুরু হয় গত শুক্রবার থেকে। শুক্রবার সকালে দিরাই উপজেলার চরনারচর গ্রামের পাশের কামান-কচমা বিলে জোর করে মাছ ধরে নেন ৫০০ থেকে ৭০০ লোকজন। পরদিন শনিবার আবারও হাজারো মানুষ বিভিন্ন যানবাহনে করে এসে এই বিলে লুটপাট চালায়। এরপর থেকে প্রতিদিন চলছে লুটপাট। কামান-কচমা, শতোয়া, বাইল্লা, ভাটিগাং বিল ছাড়াও এ পর্যন্ত লুট করা হয় শাল্লার জোয়ারিয়া বিল, দিরাইয়ের আতনি বিল, লাইড়া-দিঘা ও চইনপট্টা বিলের মাছ।
দিরাইয়ের কামান-কচমা বিলের ইজারাদার চরনারচর বিএম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুধীর বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা সরকারকে প্রতি বছর ৫০ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব দিই। দুই দিনে আমাদের বিলের দুই কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে। ১৫-২০ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ নিয়ে গেছে। পুলিশের সামনেই মাছ নিয়ে গেছে তারা। পুলিশের কিছু করারও ছিল না, কারণ পুলিশ ছিল ১০ জন, মাছ ধরতে এসেছিল আট থেকে ১০ হাজার মানুষজন।’
স্থানীয় লোকজন ও ইজারাদাররা জানিয়েছেন, দিরাই-শাল্লা উপজেলার শ্যামারচর, ললোয়ারচর, মাইতি, কার্তিকপুর, নোয়াগাঁও, চিকাডুপি, বল্লভপুর, উজানগাঁও, সোনাকানি, নিজগাঁও, মির্জাপুর, রাহুতলা, শরীফপুর, কাশীপুরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন জলমহালের মাছ লুটের সঙ্গে জড়িত।
গত শনিবার ও রবিবার শাল্লার যাত্রাপুর গ্রামের পাশের জোয়ারিয়া বিলের মাছ ধরে নিয়ে যান ছব্বিশা, দামপুর, কান্দিগাঁও, ইয়ারাবাদ, কান্দকলা, রঘুনাথপুর, যাত্রাপুর গ্রামের হাজারখানেক লোকজন। বিলের পাহারাদাররা জলমহালে থাকলেও লুটপাটকারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাধা দেওয়ার সুযোগ ছিল না।
জোয়ারিয়া বিলের ইজারাদার যাত্রাপুর হিলিপ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি হিমাদ্রী সরকার বলেন, ‘বিলে বাঁশ-কাঠা দেওয়া, পাহারাদার রাখাসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আগামী বছর মাছ ধরার কথা ছিল। কিন্তু গত দুই দিন জোর করে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
রবিবার সকালে দিরাইয়ের মেঘনা-বারঘর বিলের ও একই উপজেলার আতনি বিলের (শাল্লা উপজেলার জয়পুর গ্রামের সামনে) মাছ ধরে নিয়ে যান বিলের আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষজন। সোমবার দিরাই উপজেলার কাশীপুর লাইড়া দীঘা গ্রুপ ফিশারির এলংজুরি ও আলীপুর গ্রামের পেছনের লাইড়া-দীঘা ও চইনপট্টা বিলের পাইলের প্রায় কোটি টাকার মাছ ধরে নিয়ে যান বিলের আশপাশের লোকজন।
মাছ লুটের বিষয়ে দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মেঘনা ও কামান বিলের মাছ ধরা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছি। এলাকার লোকজন কিছু বিলের মাছ ধরেছে। লাইড়া দীঘা গ্রুপ ফিশারির পাইলের অংশে জোর করে মাছ ধরার অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া জোয়ারিয়া বিলে মাছ ধরার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছি। হাজার হাজার লোক ভোরে মাছ ধরতে যায়। এসব বিল থানা থেকে অনেক দূরে, তাই পুলিশ যাওয়ার আগেই লোকজন চলে যায়। যাদের ঘটনাস্থলে পেয়েছি তাদের বুঝিয়েও কোনও লাভ হয়নি। এতো হাজার মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। বিলের পাহারাদার ও পুলিশের পক্ষে এতো মানুষকে বাধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপরও যারা মাছ ধরে নিয়ে গেছেন তাদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছি। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) জাকির হোসেন বলেন, ‘কয়েকটি বিলের মাছ লুটের অভিযোগ পেয়েছি। লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্থানীয় কয়েকজন জেলে জানিয়েছেন, জলমহালগুলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা নিয়ে বছরের পর বছর আওয়ামী লীগের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। নেতারা পালিয়ে যাওয়ার পর গ্রামের লোকজন জোর করে মাছ ধরে নিয়ে যান। মেঘনা বারোঘর জলমহালের মালিক ছিলেন দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় ও জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। এখানে কাগজেই শুধু মৎস্যজীবী সমাবায় সমিতির নামে ইজারা নিয়ে আসা হয়। বাস্তবে ভোগদখল করেন নেতারা। গত পাঁচ দিনে ঘোষণা দিয়ে আটটি জলমহালের মাছ ধরে নিয়ে যান জলমহালের আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা।
মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলো বলছে, অন্তত সাত কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে। নবীনগর উত্তর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রীতুষ বর্মণ বলেন, ‘সাত কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে। লিখিতভাবে বিষয়টি সুনামগঞ্জ জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি আমরা।’
এ ব্যাপারে জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘দিরাইয়ের একটি জলমহাল থেকে জোর করে মাছ ধরে নেওয়ার অভিযোগ পেয়েছি। এ ছাড়া আর কোনও অভিযোগ পাইনি। তবে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হবে। লুটপাটে জড়িতদের খুঁজে বের করতে বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলেছি। ঘটনার তদন্ত চলছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।