সাইফুল ইসলাম : বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মানিকগঞ্জ কার্যালয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রায় সব কার্যক্রম বর্তমানে সক্রিয় একটি দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। প্রকাশ্যেই চলছে ঘুষের লেনদেন। টাকা দিলেই মিলে পাশের নিশ্চয়তা। এসব অনিয়ম চোখে পড়লেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কার্যত নির্বিকার থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন সেবা প্রত্যাশীরা।

প্রায় এক মাস ধরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ বিআরটিএ কার্যালয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসা অধিকাংশ আবেদনকারী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছেন। অথচ লাইসেন্স প্রাপ্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষায় ফেল করার পরও দালাল চক্রকে নির্দিষ্ট অঙ্কের উৎকোচ দিলেই ‘পাশ’ নিশ্চিত করা হচ্ছে। দিন শেষে এই উৎকোচের অর্থ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও দালাল চক্রের সদস্যদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে।
বিআরটিএ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা পরিচালনার জন্য চার সদস্যবিশিষ্ট একটি বোর্ড রয়েছে। বোর্ডের সভাপতি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্য সচিব বিআরটিএ’র মোটরযান পরিদর্শক, সদস্য হিসেবে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একজন মেডিকেল অফিসার ও জেলা ট্রাফিক বিভাগের একজন ইন্সপেক্টর দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি বুধবার ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিগত তিন সপ্তাহে মোট ৬৭১ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন, যার মধ্যে ৪৪৭ জনকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় মোটরসাইকেল চালানোর সময় পা মাটিতে পড়লে অথবা প্রাইভেটকার চালানোর সময় নির্ধারিত ট্র্যাকের বাইরে গেলে বা অপ্রয়োজনে ব্রেক কষলে পরীক্ষার্থীকে ফেল করার বিধান রয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব নিয়ম উপেক্ষা করে জনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা উৎকোচের বিনিময়ে পরীক্ষায় ‘পাশ’ করিয়ে দিচ্ছে দালাল চক্র।
এই চক্রের সঙ্গে বিআরটিসির ইনস্ট্রাকটর পলাশ, তসলিম, আবু হানিফ, বিআরটিএ মানিকগঞ্জ কার্যালয়ে মাস্টাররোলে কর্মরত অজিৎ, জাহিদসহ কয়েকজন কর্মচারী এবং উসমান, কবির, সুজন, হাসান, রাজীবসহ একাধিক দালালের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত বুধবার মানিকগঞ্জ কালেক্টরেট স্কুল মাঠে সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুর পৌনে তিনটার দিকে মোটরসাইকেলের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার তদারকির দায়িত্বে ছিলেন বিআরটিএ’র মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নেসার হোসেন। মাঠের পশ্চিম প্রান্তে একটি স্টেজে বসে তিনি লার্নার কার্ডের রোল নম্বর অনুযায়ী পরীক্ষা গ্রহণ করছিলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার্থীদের ডাকাডাকি করতে দেখা যায় অজিৎকে। একই সময় স্টেজের সামনেই দালাল উসমান পরীক্ষার্থীদের মোটরসাইকেল চালানোর পরীক্ষা কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরীক্ষার্থীদের প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ম অনুযায়ী মোটরসাইকেল চালাতে ব্যর্থ হলেও পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক নেসার হোসেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরাসরি নজরদারি করেননি। বরং অজিৎ ও উসমানের ইঙ্গিতেই পাশ-ফেল নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া যেসব পরীক্ষার্থীর মোটরসাইকেল তুলনামূলক বড়, তাদের কাছে দালাল উসমান নিজের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ভাড়া দিয়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে আদায় করা হলেও বিষয়টি উপেক্ষা করেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে প্রাইভেটকার চালানোর পরীক্ষায় বিআরটিসির ইনস্ট্রাকটর পলাশ, তসলিম, আবু হানিফ এবং দালাল কবিরসহ কয়েকজনকে সরাসরি পরীক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা করতে দেখা যায়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে নাকি তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তা হঠাৎ দেখলে বুঝার উপায় নেই। মাঠের মাঝখানে একটি চেয়ারে বসে দালালদের কথামতো পাশ-ফেল নির্ধারণ করছিলেন বিআরটিএ’র মোটরযান পরিদর্শক মো. কাফিউল হাসান মৃধা।
ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা বোর্ডের সভাপতি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে ওই দিন পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল-মুনতাসির মামুন মনি। তবে তিনি মাত্র দুই মিনিট অবস্থান করেই কেন্দ্র ত্যাগ করেন।
পরিচয় গোপন রেখে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া একাধিক পরীক্ষার্থী জানান, দালালদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করলে পরীক্ষা না পারলেও পাশ করিয়ে দেওয়া হয়। জনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। ধামরাই থেকে আসা এক পরীক্ষার্থী বলেন, “একজনের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। পারলেও পাশ, না পারলেও পাশ।” টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার এক পরীক্ষার্থী জানান, প্রথমে তাকে ফেল দেখানো হলেও পরে লোক মারফত যোগাযোগ করলে ফেল কেটে পাশ লিখে দেওয়া হয়। শিবালয় থেকে আসা আরেক পরীক্ষার্থী জানান, চুক্তি না থাকলে পাশ করা সম্ভব হতো না (পরীক্ষার্থীদের নাম গোপন রাখা হয়েছে)।
এ বিষয়ে বিআরটিসির ইনস্ট্রাকটর আবু হানিফের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “পরীক্ষা ছাড়া পাশ করতে চাইলে বা কোনো লোক থাকলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ কইরেন।” এছাড়া চক্রের একাধিক সদস্য সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রতিবেদককে বিভিন্নভাবে প্রলোভনের চেষ্টা করেন।
ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য সচিব ও বিআরটিএ’র মোটরযান পরিদর্শক মো. কাফিউল হাসান মৃধা বলেন, “বর্তমানে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ির কাগজপত্র করা যায় না। সে কারণে মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা রাখা হয়েছে। তবে প্রাইভেটকারের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি রয়েছে।” দালাল চক্রের বিষয়ে তিনি বলেন, “ দালালদের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। ভবিষ্যতে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।”
বিআরটিএ মানিকগঞ্জের সহকারী পরিচালক মাহবুব কামাল বলেন, “পরীক্ষা কেন্দ্র পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড রয়েছে। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস. এম. রবীন শীষ বলেন, “আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। দ্রুত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তাদের নির্মূল করা হবে।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



