সিপন আহমেদ ও সাইফুল ইসলাম : মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যের একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজন্য তিনি পছন্দের উপ-পরিদর্শক (এসআই) দিয়ে থানায় গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট বাহিনী। আর তাদের দিয়েই গত ৬ মাসে কামিয়েছেন প্রায় কোটি টাকা। ওসি ও তার সিন্ডিকেট বাহিনীর গ্রেফতার বাণিজ্যের তথ্য উঠে এসেছে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও।
ওসির গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুমন চক্রবর্তী, মুত্তালিব ও মাসুদুর রহমান। এদের মধ্যে এসআই সুমন চক্রবর্তীকে শিবালয় থানায়, এসআই মুত্তালিবকে দৌলতপুর থানায় ও এসআই মাসুদকে ঘিওর থানায় বদলি করা হয়েছে। এসআই সুমন চক্রবর্তী ও এসআই মুত্তালিব ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগদান করেছে। তবে এসআই মাসুদুর রহমান এখনো সিংগাইর থানায়ই কর্মরত রয়েছে। এদিকে নানা অপকর্মে জড়িত থাকায় ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরকে তিনবার শোকজ করা হয়েছে।
বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সিংগাইর থানায় কর্মরত এসআই সুমন চক্রবর্তী ওসি জাহিদুল ইসলামের যোগসাজশে বিভিন্ন মামলার অজ্ঞাতনামা আসামী হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটক করে। আটক ব্যক্তিদের হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের নিকট হতে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে তাদেরকে জামীনযোগ্য মামলায় আটক দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে।
বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু ঘটনার তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখিত বেশ কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ নেয়া হয়। এ সময় সেসব ঘটনার সত্যতাও মেলে।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে সিংগাইর থানার তালেবপুর ইউনিয়নের কাংশা গ্রামে মুক্তার হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে চুরির অপরাধে আটক করে স্থানীয়রা। এরপর রাতভর তাকে নির্যাতন করা হলে পরদিন সকালে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় ১৫ সেপ্টেম্বর মামলা করেন মুক্তার হোসেনের ছেলে আশিকুর রহমান। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে প্রান্ত, নবু ও যুবায়ের নামে তিনজনকে আটক করে এসআই সুমন চক্রবর্তী। পরে ওসির নির্দেশে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
এছাড়াও বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামসা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. আতিককে আটক করে এসআই সুমন চক্রবর্তী। তাকে হত্যা ও একাধিক নাশকতা মামলায় গ্রেফতারের ভয় দেখানো হয়। পরে এসআই সুমন ওসির সঙ্গে যোগসাজশে আতিকের পরিবারের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
একইভাবে ধল্লা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইউনুসকে আটক করে এসআই সুমন। ইউনুসকেও হত্যাসহ একাধিক মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে ১ লাখ টাকা আদায় করে। পরে ওসির নির্দেশে ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
এদিকে গত বছরের ১৮ অক্টোবর সিংগাইর উপজেলার ভাকুম এলাকার ভাই-ভাই জেনারেল স্টোরের মালিক মো. জয়নালের বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ করে স্থানীয়রা ৯৯৯-এ ফোন করে। পরে ওসির নির্দেশে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন এসআই সুমন ও মাসুদুর রহমান। আটক জয়নালের পরিবারের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ৫৪ ধারায় তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, সিংগাইরের একটি সি.আর মামলার আসামী মীর মো. শাজাহান, মীর বাবু, আতাউল হক ও মো. আমিনকে গত বছরের ২ অক্টোবর গ্রেফতার করে এসআই সুমন। এদের মধ্যে মীর শাহজাহান ও মীর বাবু পিতা-পুত্র। পরে পিতা মীর শাহজাহানের সামনে ছেলে মীর বাবুকে থানার ভেতরেই প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ওসি জাহিদুল ইসলাম ও এসআই সুমনকে দুই লাখ টাকা উৎকোচ দেয় তাদের পরিবারের লোকজন। এছাড়া আতাউল হক ও মো. আমীনের পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ১ লাখ টাকা আদায় কওে ওসি জাহিদুল ইসলাম ও এসআই সুমন।
সিংগাইর উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ওয়াসিমকে আটক করে এসআই সুমন। তাকে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এসআই সুমন।
উপজেলার চর আজিমপুর এলাকার মহসীন খানকে আটক করে থানায় এনে বিভিন্ন মামলায় জড়ানোর ভয়ভীতি দেখায়। এর প্রেক্ষিতে মহসীনকে হত্যা মামলায় না জড়িয়ে ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় দিয়ে রিমান্ড না চাওয়ার শর্তে এসআই সুমনকে ৮০ হাজার টাকা উৎকোচ দেয় মহসীনের স্ত্রী।
এছাড়া ধল্লা বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী রমজানকে আটক করে থানায় এনে একাধিক মামলায় না দেয়া এবং রিমান্ড না চাওয়ার শর্তে রমজানের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় এসআই সুমন। এরপর রমজানকে পুলিশের ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় আদালতে প্রেরণ করা হয়।
অনুরূপভাবে, শায়েস্তা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফরমান আলীকে আটকের পর একাধিক মামলায় না জড়িয়ে শুধুমাত্র ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে জানিয়ে ওসির নির্দেশে তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ নেয় এসআই সুমন।
তালেবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহানুর বক্সকে আটক করে ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ নেয় এসআই সুমন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিংগাইর থানায় দায়েরকৃত সবগুলো রাজনৈতিক মামলার দায়িত্ব দেয়া হয় ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের আস্থাভাজন এসআই সুমন চক্রবর্তী, মুত্তালিব ও মাসুদুর রহমান মাসুদকে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামীদের হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
বিভিন্ন আসামীদের আটকের পর তাদের আত্মীয়-স্বজনরা থানায় আসলে তাদেরকে রাত ১০টার পরে থানার সামনের স্কুলমাঠে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শর্র্তে অর্থ আদায় করে সিন্ডিকেটের সদস্য এসব এসআইরা। অবস্থাভেদে আসামীদের কাছ থেকে ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এছাড়া আসামী ধরার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মামলার বাদির কাছে থেকেও অর্থ আদায় করতো ওসির এই সিন্ডিকেট বাহিনী।
জানা গেছে, রামকান্তপুরের ছাত্তার এর কাছ থেকে ৭০ হাজার, সিংগাইর বাজারের ব্যাবসায়ী শাহীন বক্স এর কাছে ৩০ হাজার, বাইমাইল এর তসলিমুদ্দিন স্বপনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করেছে চক্রটি। এরা সবাই ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বর্তমান ও সাবেক পদধারী নেতা। কিছুদিন পূর্বে সাভার থেকে ৫ থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে সহজ জামিনযোগ্য মামলায় আদালতে প্রেরণ করে। এরপর তাদের জামিন হলে জেলগেট থেকে তাদেরকে ফের গ্রেফতার করে অন্য মামলায় চালান দেয়া হয়।
এছাড়া সিংগাইর পৌরসভার আজিমপুর এলাকার সাঈদ ওরফে পোকা সাঈদকে গ্রেফতারের পর ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর নিজের রুমে সাঈদকে নিয়ে বাকি সবাইকে বের করে দিয়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থানায় দালালি করা সাঈদকে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। ভয়ে ১ লাখ টাকা দিতে রাজি হয় সাঈদ। পরে রাতের আধারে সাঈদের স্ত্রী থানায় গিয়ে সেই টাকা পৌছে দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে কানাঘূসা শুরু হলে পরবর্তীতে তাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। জামিনে বের হয়ে পুনরায় গ্রেফতারের ভয়ে আবারও ওসিকে ৫০ হাজার টাকা দেয় সাঈদ। বর্তমানে এই সাঈদের মাধ্যমে সিংগাইরের আওয়ামী লীগের পালিয়ে থাকা নেতাদের কাছ থেকে গোপনে অর্থ আদায় করছেন ওসি জাহিদুল।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই মাসুদুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আপনার আর কিছু জানার থাকলে আমার সামনে এসে কথা বলেন। অপরদিকে, এসআই সুমন চক্রবর্তী বলেন, আমি সিংগাইর থানায় থাকাকালীন সময়ে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে বেশ কিছু অভিযান করেছি। আমি কোন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নই। আমি কাউকে আটক বা গ্রেফতার করে কোন টাকা পয়সা নেইনি। আর চোর হত্যা মামলায় যে ৩ জনকে আটক করা হয়েছিল তাদের ওসি এবং সার্কেল স্যারের নির্দেশে মুচলেকার মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে আমি কোন ধরনের লেনদেন করিনি।
এ নিয়ে সিংগাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর, আমার বিরুদ্ধে করা এসব অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। কেউ যদি এসবের প্রমাণ দিতে পারে তাহলে আমার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেয়া হবে তা মাথা পেতে নেব। আর যদি প্রমাণ না দিতে পারে আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিব।
বিষয়টি নিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার ( সিংগাইর সার্কেল) নাজমুল হাসান বলেন, তাদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সেগুলো জানানো হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ২ জন এসআইকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে এবং আরেকজনের বদলি প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলমান রয়েছে।
সিংগাইরের ওসিকে শোকজের বিষয়টি নিশ্চিত করে মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মোছা. ইয়াছমিন খাতুন বলেন, প্রাথমিকভাবে তিন এসআইকে বদলি করা হয়েছে। বিভাগীয় তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।