জুমবাংলা ডেস্ক : পাহাড়ি জেলা রাঙ্গামাটিতে আগ্রহ বাড়ছে বিদেশি ফল চাষে। বাণিজ্যিকভাবে নানা ধরণের বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে পাহাড়ের বিভিন্ন প্রত্যন্তের আনাচে-কানাচে। দেশি বাজারে এসব ফলের চাহিদা থাকার কারণে পাহাড়ে অনেকেই ফল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। কয়েক বছর আগেও ড্রাগন ও রাম্বুটান ফল ছিল বড় বড় সুপার শপের শৌখিন ফল। জাহাজ বা প্লেনে চড়ে আসতো বিদেশ থেকে। ধনীদের বাজারে থলেতে উঠতো চড়া মূল্যের বিনিময়ে। বর্তমানে ফুটপাতে ঝুঁড়িতেও বিক্রি হচ্ছে এসব ফল। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে পাহাড়ে।
কৃষিবিদরা বলছেন, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে অনেকেই কাজ হারানোর কারণে গ্রামে ফিরে গেছেন। দেশের বাইরে থেকেও ফিরে এসেছেন অনেক শ্রমিক। আর তারাও গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকছেন।
সরেজমিনে স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাঙ্গামাটি শহরের ফুটপাত ও স্থানীয় বাজারে ড্রাগন ও রাম্বুটান ভরপুর। ড্রাগন কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত এবং রাম্বুটান প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। এসব ফলে বেশ চাহিদা রয়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
ড্রাগন চাষ
ভিয়েতনামের জাতীয় ফল ড্রাগন। মিষ্টি ও টক-মিষ্টি স্বাদের ড্রাগনে স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং প্রসাধনী গুণ থাকায় দিনদিন বাংলাদেশে এর চাহিদা বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে দেশে। আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশে থাকায় রাঙ্গামাটি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়েছে বিদেশি ক্যাকটাস প্রজাতীয় এ ফলের।
রাঙ্গামাটির সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নের মধ্যমপাড়া এলাকায় কৃষি উদ্যোক্তা মিল্টন চাকমা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে তুলেছেন ড্রাগন ফলের বাগান। দূর থেকে দেখলে মনে হয় স্ব-যত্নে ক্যাকটাসের আবাদ করেছেন তিনি। একটু পাশে যেতেই চোখ ধাঁধিয়ে নয়নাভিরাম লাল ফলের সারিতে। প্রতিটি গাছে রয়েছে ফুল, মুকুল ও ড্রাগন ফল।
রাঙ্গামাটি শহরের ভেদভেদী এলাকার বাসিন্দা ড্রাগন চাষি মিল্টন চাকমা জানান, ২০১০ সালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া যান। ওখানে অনেক কষ্টে দিনযাপন করার কারণে দীর্ঘ ৮ বছর থাকার পর ওখান থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আসেন। তখন করোনা মহামারি ছিল। তখন তিনি কি করবেন দিশেহারা হয়ে যান। এরপর তিনি অবসর সময় ইউটিউব দেখে ড্রাগন চাষ করার উদ্যোগ নেন। এরপর তিনি তার নাটোর জেলার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ৪৫ টাকা দরে প্রায় ৪ হাজার চারা ড্রাগন ফলের চারা কিনে নিয়ে আসেন। পরে তিনি ২০২২ সালে সাপছড়ি ইউনিয়নে প্রায় ২ একর পাহাড়ের চূড়ায় ড্রাগন ফলের চাষাবাদ করেছেন। এতে তিনি সফলও হয়েছেন।
তিনি জানান, গত বছর তিনি এনআরবিসি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা লোন নেন এবং ব্যক্তিগত টাকাসহ প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বাগান করতে খরচ হয়। এবছর তিনি ১০ টনের অধিক ফল বাগান থেকে তুলতে পারবেন। প্রতি কেজি ড্রাগন ফল ৩০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার ড্রাগন ফল চাষি জাহাঙ্গীর আলম জানান, ২০১১ সালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটে ড্রাগন ফলের চাষ দেখে তিনি এ ফলের চাষবাদ করার উদ্যোগ নেন। পরে তিনি রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুকুল দেওয়ানের কাছ থেকে মাত্র ৪টি ড্রাগন ফলের চারা এনে রোপন করেন। এরপর থেকেই তিনি প্রতিবছর ড্রাগন ফলের চাষ করে আসছেন।
তিনি জানান, এবারও বাড়ির আঙিনায় বাণিজ্যিকভাবে প্রায় ১ একর জমিতে ১০০টি ড্রাগন ফলের চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। এছাড়াও তিনি প্রতিবছর ড্রাগন ফল চাষ করে ৩০ হাজার থেকে প্রায় ৫০ হাজার পর্যন্ত মুনাফা অর্জন করেন। তবে প্রতিবছরের তুলনায় এবার বেশি মুনাফা অজর্ন হবে । তাঁর কাছে প্রায় ৪শত টি ড্রাগন ফলের চারা রয়েছে।
রাম্বুটান চাষ
রাম্বুটান একটি মালয়েশিয়ান ফল। লিচুর বিকল্প হিসেবে মনে করা হয় রাম্বুটানকে। লাল রঙের ফল ভেতরে লিচুর মতোই দেখতে। খেতেও লিচুর মতোই। এটি শীতে তেমন একটা টিকে থাকতে পারে না। গরমের সময় এর ফলন বেশ ভাল হয়।
নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ি ইউনিয়নের রাম্বুটান চাষি মোহাম্মদ জিয়া জানান, নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ি ইউনিয়নে ৪ থেকে ৫ কানি জমিতে বিদেশি ফল রাম্বুটানের চাষ করছেন তিনি। প্রায় ২৫০টি গাছ রোপন করছেন তিনি। ফলনও ভালো হয়েছে। তিনি পাইকারি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
লংগদু উপজেলার বগাচতর ইউনিয়নের মহাজন পাড়া এলাকার রাম্বুটান চাষি মো. নাজমুল জানান, নিজ বাড়ির আঙিনায় পরীক্ষামূলকভাবে ৩২টি বিদেশি ফল রাম্বুটানের চারা রোপণ করা হয়েছে। এই চারাগুলো নরসিংদী জেলার শিবপুর থেকে সংগ্রহ করেছেন। সেখান থেকে তিন হাজার টাকা দরে চারাগুলো ক্রয় করেন। তিনি আরো জানান, ইউটিউব দেখেই চারা রোপণ থেকে শুরু করে পরিচর্যা সবকিছু করতে সক্ষম হয়েছেন। এতে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। ফলটির বাজার মূল্যও যথেষ্ট ভালো । বাণিজ্যিক ভাবেও সফল হতে চান তরুণ এই কৃষক।
রাঙ্গামাটি কৃষি অফিস সূত্র জানা যায়, এ দেশের আবহাওয়া লাল, হলুদ এবং সাদা ড্রাগন ফল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এটি লতানো কাটাযুক্ত গাছ, যদিও এর কোনো পাতা নেই। গাছ দেখতে অনেকটা সবুজ ক্যাকটাসের মতো। ড্রাগন গাছে শুধুমাত্র রাতে স্বপরাগায়িত ফুল ফোটে। ফুল লম্বাটে সাদা ও হলুদ রঙয়ের হয়। তবে মাছি, মৌমাছি ও পোকা-মাকড় পরাগায়ন ত্বরান্বিত করে। কৃত্রিম পরাগায়নও করা যায়। এ গাছকে ওপরের দিকে ধরে রাখার জন্য সিমেন্টের/বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ওপরের দিকে তুলে দেয়া হয়। ড্রাগনের চারা বা কাটিং রোপণের ১০থেকে ১৫ মাসের মধ্যেই ফল সংগ্রহ করা যায়। এপ্রিল-মে মাসে ফুল আসে আর শেষ হয় নভেম্বর মাসে। ফুল আসার ৩০থেকে ৪০দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। নভেম্বর মাস পর্যন্ত ফুল ফোটা এবং ফল ধরা অব্যাহত থাকে। এক একটি ফলের ওজন ২৫০গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সূত্রে আরো জানা যায়, রাম্বুটান ফলনের জন্য একবেলা রোদ এবং একবেলা ছায়া দরকার হয়। এজন্যই এটি মিশ্র বাগানে অন্য গাছের সাথে চাষ করার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। বেশিক্ষণ সূর্যের আলোতে থাকলে এর পাতায় সানবার্ন হয় বা পুড়ে যায়। এজনই অনেকে শেডের ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে শেড দিয়ে চাষ করা গেলে রাম্বুটানের উৎপাদনও বেশ ভাল হয়। রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান জানান, এবার রাঙ্গামাটিতে ৩৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৯২ মেট্রিক টন। এছাড়া রাম্বুটানের চাষ হয়েছে ৬ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ১৪ মেট্রিক টন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।