জুমবাংলা ডেস্ক : স্থানীয় সমাজপতি ও আলেমদের অনুরোধে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিয়ে ছয় স্ত্রীর মধ্যে দুই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে এখন চার স্ত্রীর পরিবার নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন কুষ্টিয়ার রাজিবুল। জেলায় ব্যাপক আলোচিত রাজিবুলের একসাথে সাত স্ত্রী নিয়ে সংসার চালানোর বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারের পর থেকে এলাকায় ব্যাপকভাবে সমলোচিত হন রাজিবুল।
শনিবার (৮ জুন) স্থানীয় সমাজপতি ও আলেমদের নির্দেশনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে রাজিবুল দুই স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান গ্রহণ করেন। তার এই সিদ্ধান্ত সকল মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন।
জানা যায়, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ি গ্রামের মিয়া পাড়ার আইনাল মন্ডলের ছেলে রাজিবুল মায়ের ইচ্ছে পুরনে পর্যায়ক্রমে সাতটি বিয়ে করে তাদের সাথে সুখের সংসার চালিয়ে আসছিলেন। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় কানাঘুষা চললেও তেমন কোনো প্রতিক্রীয়া ছিল না। মাঝে এক স্ত্রী নিজেই তালাক দিয়ে চলে যান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার সকাল ১০টায় গ্রামের ২২ প্রধান এক হয়ে বিশিষ্ট আলেমগণকে সাথে নিয়ে পাটিকাবাড়ি বাজারে সামাজিক বৈঠক ডাকেন। রাজিবুল স্বতস্ফুর্তভাবে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্ত্রীকে নিয়ে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রধানের ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় মাতবর নাজিম মন্ডল।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সফর উদ্দিন, লিটন মন্ডল, মাজিলা দারুস সুন্নাহ বহুমূখী মাদরাসার মুহতামিম হাফেজ মো: মুফতি আলমগীর হোসাইন, পাটিকাবাড়ী বায়তুল আমান জামে মসজিদের পেশ ঈমাম মো: মীর শফিকুল ইসলাম, পাটিকাবাড়ী হেফজখানা ও বহুমূখী মাদরাসার শিক্ষক মিজানুর রহমান, মাজিলা পশ্চিমপাড়া দারুলউলুম হাফিজীয়া ক্বারিয়ানা মাদরাসার মুহতামিম ক্বারী মশিউর রহমানসহ স্থানীয় জনগন।
বৈঠকে শরিয়ত মোতাবেক চারের অধিক স্ত্রী রাখার বিধান না থাকার ইসলামী ব্যাখা দেন মুহতামিম হাফেজ মো: মুফতি আলমগীর হোসাইন। সমাজপতি ও স্থানীয় আলেমদের কোরআন হাদিসের আলোকে অনেক ব্যাখা তুলে ধরেন।
বৈঠকের প্রধান নাজিম মন্ডল বলেন, ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক চার স্ত্রীর বেশি রাখার বিধান নেই। সামাজিকভাবে বসে আমরা তাকে সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।
স্ত্রীদের তালাক দিতে আপনারা বাধ্য করতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজিবুল তার দুই স্ত্রীকে তালাক দিবেন বলে নিজেই স্বতস্ফুর্ত অঙ্গীকার করেছেন। আমরা তাকে বাধ্য করিনি, তাকে মারধরও করিনি।
রাজিবুল ইসলাম বলেন, গ্রামের ২২ প্রধান নিজেরাই এক হয়ে সামাজিক বৈঠক ডেকে আমাকে উপস্থিত হতে বলেন। আমি তাদেরকে বলেছিলাম এইজন্য আমার সময় প্রয়োজন। কারণ আমি যাদের বিয়ে করেছি তারা সবাই গরিব ঘরের সন্তান। তাদের চলার মতো একটা অবস্থান তৈরি করে পরবর্তীতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। কিন্তু তারা আমার কথা না মেনে আমার দুই স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে নেন। সালিশের পর তারা আমার দুই স্ত্রীকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছেন। আমাকে এবং আমার মামাকে লাঞ্ছিত করেছে।
সামাজিক বৈঠকে উপস্থিত আরেক গ্রাম প্রধান পাটিকাবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সফর উদ্দিন বলেন, এটা অবৈধ বিয়ে। আমরা তাকে বাধ্য করিনি। উপস্থিত সকলের কথা শুনার পর নিজের আগ্রহে দুই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে স্টাম্পে স্বাক্ষর করেন এবং তাদের কাবিন ও খোরপোশ বাবদ দুই লাখ টাকা দেয়ার পর দুই স্ত্রী মেনে নিয়ে নিজ নিজ গ্রামে চলে যায়।
রাজিবের মতে, সাত স্ত্রীর সাথে সুখে সংসার করা কুষ্টিয়ার রবিজুলকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তার সংসারে নেমে আসে সামাজ প্রধানদের চাপ। মাস চারেক আগে ষষ্ঠ স্ত্রীকে তালাক দিলে তিনি চলে যান বাবার বাড়ি। এরপর ছয় স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে তার সংসার।
পাটিকাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রেজভি উজ্জামান বলেন, আমি বিভিন্ন মাধ্যমে সামাজিক বৈঠকের বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু আমাকে প্রধানরা বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলেনি তাই আমি এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না। তবে এ ব্যাপারে রাজিবুলের দুই স্ত্রীর সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাজিবুল মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন জেলার মিরপুর উপজেলার বালুচর গ্রামের কিশোরী রুবিনা খাতুনকে। বিয়ের দু’বছরের মাথায় এই দম্পতির এক ছেলে সন্তান হয়। পরে স্ত্রী ও সন্তানকে বাড়িতে রেখে লিবিয়ায় পাড়ি জমান রবিজুল। সেখানে টাইলসের কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরে লিবিয়াতে পরিচয় হয় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার হেলেনা খাতুনের সাথে। সেখানে তারা দু’জন সম্পর্কে জড়ান এবং একপর্যায়ে তাদের বিয়ে হয়।
তাৎক্ষণিক প্রথম স্ত্রীকে বিষয়টি না জানালেও পরে জানার পর তিনি এ বিয়ে মেনে নেন। এরপর প্রথম স্ত্রী রুবিনাকেও লিবিয়া নিয়ে যান রবিজুল। সেখানে দুই স্ত্রী এবং সন্তান নিয়ে ১২ বছর বাস করেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে বাবার ভিটায় দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এর কিছুদিন পরই মোবাইল ফোনে প্রেমের সম্পর্ক হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের নুরুন্নাহারের সাথে। পরে নুরুন্নাহারকে বিয়ে করেন রবিজুল। তবে নুরুন্নাহারের অভিযোগ, সম্পর্কের শুরুতে তিনি জানতেন রবিজুলের একজন স্ত্রী আছেন। রবিজুলের দাবি, মায়ের মানত রক্ষায় ধারাবাহিকভাবে তিনি চতুর্থ বিয়ে করেন। তার চতুর্থ স্ত্রীর নাম স্বপ্না খাতুন। বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে। এরপর তিন মাসে পরপর তিনটি বিয়ে করেন রবিজুল। তার পঞ্চম স্ত্রীর নাম বানু খাতুন, বাড়ি আলমডাঙ্গা উপজেলার রসুলপুর গ্রামে। ষষ্ঠ স্ত্রীর নাম রিতা আক্তার। তার বাড়ি জেলার কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদাহ ইউনিয়নে।
সর্বশেষ বিয়ে করা সপ্তম স্ত্রী মিতা খাতুনের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে। দোতলা বাড়ির সাতটি কক্ষে বসবাস করেন স্ত্রীরা। প্রত্যেক স্ত্রীর শয়নকক্ষ আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন একইভাবে।
রবিজুলের দাবি, বিধিসম্মত না হলেও তার স্ত্রীদের কারো কোনো অভিযোগ নেই। একসাথে শান্তিপূর্ণভাবেই তারা সংসার করছেন। একাধিক বিয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কুষ্টিয়ার উপপরিচালক মো: হেলাল উজ জামান বলেন, শরিয়াহ অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে করতে পারেন বৈধভাবে। এজন্য আগের সব স্ত্রীর অনুমতি থাকতে হবে। দাম্পত্য জীবনে সব স্ত্রীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো স্ত্রী গ্রহণের বিধান নেই।
সামাজিক বৈঠকে জোরপূর্বক তালাক দিতে বাধ্য করা যায় কিনা সেই প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী বলেন, সামাজিক বৈঠকে চাপ দিয়ে কাউকে তালাক দিতে বাধ্য করানো আইনের চোখে অপরাধ। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পার্থ প্রতিম শীল জানান, দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে হলে সেটা ভিন্ন। কিন্তু জোর জবরদস্তির করার কোনো সুযোগ নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।