জুমবাংলা ডেস্ক : যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার বারবাকপুর গ্রামের নাসরিনের ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি এলাকার নারী কর্মসংস্থানে সাড়া ফেলেছে। বাড়িতে জৈব সার তৈরি করে নিজের পড়ালেখার খরচ মিটিয়ে পরিবারেও অর্থের জোগান দেওয়া শিক্ষার্থী নাসরিন সুলতানার হাত ধরে এলাকার অনেক নারীই এখন উদ্যোক্তা। উচ্চ শিক্ষিত নাসরিন এখন এলাকার নারী কর্মসংস্থানের প্রতীক।
ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির পাশাপাশি তিনি কাজ করছেন নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে, যৌতুক ও নারী পাচার রোধ এবং নারীদের নানা সমস্যা নিয়ে। নারী উদ্যোক্তা নাসরিন সুলতানা যশোরের ঝিকরগাছার বারবাকপুর গ্রামের লুৎফর রহমানের মেয়ে। তিনি উপজেলা নারী সামাজিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঝিকরগাছার জাগরণী সংসদের সদস্য।
এমন কৌশল জানা থাকলে আপনিও চাইলে নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদেরও কাজে লাগাতে পারবেন। তাই আসুন জেনে নেই কিভাবে তৈরি করবেন ভার্মি কম্পোস্ট সার।
কেঁচো কম্পোস্ট একটি জৈব সার যা জমির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। ১ মাসের বাসী গোবর খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে এবং এর সাথে কেঁচোর দেহ থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে যে সার তৈরি হয় তাঁকে কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট বলা হয়। এটি সহজ একটি পদ্ধতি ১ মাসের বাসী গোবর দিয়ে ব্যবহার উপযোগী উৎকৃষ্ট জৈব সার তৈরি করা হয়। এ সার সব ধরণের ফসল ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়। ‘ভার্মি কম্পোষ্ট’ বা কেঁচোসারে মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বায়ু চলাচল বৃদ্ধি পায়। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।
প্রধান উপকরণ
কেঁচো-২০০টি, মাটির তৈরি নালা বা চারি অথবা ইট দিয়ে নির্মিত চৌবাচ্চা এবং ১ মাসের বাসী গোবর।
ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি করার পদ্ধতি
– ২ মিটার লম্বা, ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট ইট দিয়ে চৌবাচ্চা তৈরি করতে হবে। চৌবাচ্চার উপর টিনের/খড়ের চালা দিতে হবে।
– গর্তের মধ্যে বাসী পচা গোবর ঢেলে ভরে দিতে হবে। অতঃপর ২০০ থেকে ৩০০ কেঁচো ছেড়ে দিতে হবে। এ কেঁচোগুলো গোবর সার মল ত্যাগ করবে। এই মলই কেঁচো সার।
– কেচোর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে সার তৈরীর সময় নির্ভর করে। সংখ্যা বেশী হলে দ্রুত কেঁচো সার তৈরি হবে। কেঁচো সার দেখতে চায়ের গুড়ার মত।
– সার তৈরি হওয়ার পর চৌবাচ্চা হতে সতর্কতার সাথে কম্পোস্ট তুলে চালুনি দিয়ে চালতে হবে। সার আলাদা করে কেঁচোগুলো পুনরায় কম্পোস্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করতে হবে।
– কেঁচো সার বাজারের চাহিদা অনুযায়ী/ নিজস্ব ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সাইজের প্যাকেট/বস্তা ভর্তি করে রাখা যেতে পারে।
কোথায় ব্যবহার করবেন
সকল প্রকারের শাক সবজি ক্ষেতে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে শাক সবজির ফলন বাড়ানো যায়। ধান, গম, পাটসহ বিভিন্ন ফলবাগানে এই সার ব্যবহার করে ভাল ফলন পাওয়া যায়। এই সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ে মাটিতে বায়ুচলাচল বৃদ্ধি পায়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, মাটির বিষাক্ততা দূরীভূত হয়। মাটির অনুজৈবিক কার্যাবলী বৃদ্ধি পায় ফলে মাটি হতে গাছ্র পুষ্টি পরিশোধন ক্ষমতা বেড়ে যায়। এই সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার মাত্রার ১/২ অংশ ব্যবহার করলেই চলে। ধানের জমিতে বিঘাপ্রতি ৫০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে অর্ধেক ফলন পাওয়া যায়। এই সার পুকুরে ব্যবহার করে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপাদন ত্বরান্বিত করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
চালুনীর সময় সাবধান থাকতে হবে যেন শিশু কেঁচো মারা না যায়। শিশু কেঁচোগুলো পুনরায় গর্তে রক্ষিত বাসী গোবরের মধ্যে কম্পোস্ট তৈরির জন্য ছেড়ে দিতে হবে। পিপঁড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, মুরগী, ইঁদুর, পানি ও পোকার কামড় থেকে কেঁচোগুলোকে সাবধানে রাখতে হবে। প্রয়োজনে চৌবাচ্চার উপর মশারী ব্যবহার করতে হবে।
নাসরিনের মত আপনিও এই পদ্ধতিতে হতে পারেন স্বাবলম্বী। নাসরিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঝিকরগাছা মহিলা কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যায়নের পাশাপাশি ডিপ্লোমা করেছেন কৃষির ওপর। তার জৈব সার কারখানায় প্রতি মাসে অন্তত ৩০ মণ ভার্মি কম্পোস্ট সার (কেঁচো সার) তৈরি হয়। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে তিনি দুইটি নান্দায় (সার তৈরির পাত্র) দেড়শ টাকা দিয়ে একশ গ্রাম কেঁচো কিনে শুরু ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি শুরু করলেও বর্তমানে এ কারখানা থেকে প্রতি মাসে আয় হয় ১০-১২ হাজার টাকা।
নাসরিন সুলতানার জৈব সারের এ কারখানা দেখে শুধু বারবাকপুর নয় আশেপাশের গ্রামগুলোতেও গৃহিণী ও যুবক-যুবতীরা কেঁচো কম্পোস্ট সার কারখানা গড়ে তুলেছেন। বারবাকপুর গ্রামের মাজেদা বেগম বলেন, “নাসরিনের কাছ থেকে কেঁচো কম্পোস্টের প্রশিক্ষণ নিয়ে জৈব সার কারখানা তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়েছি। এখন নিজেদের জমিতে এ সার ব্যবহার করে যা উদ্বৃত্ত থাকে তা বিক্রি করে সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে থাকি।” একই কথা বলেছেন, বারবাকপুরের গৃহিণী বিথি বেগম, সাকিনা খাতুন ও পদ্মপুকুর গ্রামের সেলিনা বেগম।
ঝিকরগাছার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আইয়ুব হোসেন বলেন, “নাসরিন এলাকায় নারী কর্মসংস্থানের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তার কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরি দেখে বারবাকপুর গ্রামের অনেক নারী এখন জৈব সার তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন। কৃষিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে উদ্যেক্তা নাসরিন সুলতানা ২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কারও পেয়েছেন।”
নাসরিন সুলতানা বলেন, “আমি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে হাঁস-মুরগির ভ্যাকসিনের, পিছিয়ে পড়া নারীদের স্বামী নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে জেন্ডার সমতা, ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি ও বসতবাড়িতে সবজি চাষ করে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর ও বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে পাড়ায় পাড়ায় প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকার যুবক-যুবতী ও নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উপজেলার এক হাজার ৯২০টি পরিবারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করছি। পাশাপাশি উপজেলা নারী সামাজিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৬৪টি গ্রুপ নিয়ে বাল্যবিয়ে যৌতুক ও নারী নির্যাতন বিষয় কাজ করছি।”
ঝিকরগাছা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা অনিতা মল্লিক বলেন, “নাসরিন সুলতানা স্বাবলম্বী ক্যাটাগরিতে ২০২১ সালে উপজেলা পর্যায় জয়িতা পুরস্কার পান।তিনি নারী ও যুব সমাজের উদাহরণ।”
রোমান্সে ভরপুর উল্লুর নতুন এই ওয়েব সিরিজ, ভুলেও কারও সামনে দেখবেন না
ঝিকরগাছা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আরব আলী বলেন, “নাসরিন সুলতানা উদ্যোক্তা হিসেবে ভার্মি কম্পোস্ট সার (কেঁচো সার) কারখানা করে একদিকে সবজি চাষে বিশেষ অবদান রাখছেন অন্যদিকে এলাকার নারী ও যুবককেরা তাঁকে দেখে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেরণা পাচ্ছেন।” তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
– বাসস, কৃষি বাতায়ন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।