জুমবাংলা ডেস্ক : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দেখা মিলেছে তীব্র বিষধর সামুদ্রিক সাপের। এ নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে জোয়ারের পানিতে তিনটি সাপ ভেসে এলো। যার মধ্যে একটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন পর্যটকরা।
বুধবার (৫ জুন) বিকেলেও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে ভেসে আসে হলুদ পেটযুক্ত ইয়েলো বেলিড সী স্নেক। আর সৈকতে এই ধরনের সাপ দেখলে লোকজনকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ প্রশাসনের।
সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট বালিয়াড়িতে আটকে আছে সামুদ্রিক সাপ। নেই নড়াচড়া। বলা হচ্ছে ইয়েলো বেলিড সী বা হলুদ পেটযুক্ত সামুদ্রিক সাপ। মূলত আটলান্টিক মহাসাগর ছাড়া বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মহাসাগরীয় পানিতে এই সাপ পাওয়া যায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, হলুদ পেটযুক্ত সামুদ্রিক সাপ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং ভারত মহাসাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ১৮-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বসবাস করে। এটি সারা বিশ্বের সবচাইতে বিষাক্ত সাপ।
তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সাগরেও এটির বিস্তৃতি রয়েছে। এই সাপ সাধারণত সৈকত থেকে দূরে সাগরের মুক্ত পানিতে সাঁতার কাটে। এরা সাগরের উপরের স্তরে অর্থাৎ পেলাজিক স্তরে বসবাস করে এবং সাগরতলে এদের দেখা পাওয়া যায় না।
হলুদ পেটযুক্ত সামুদ্রিক সাপ ইয়েলো বেলিড হাইড্রোফিনি সাবফ্যামিলির একটি বিষধর সাপ। সাপটির মাথা লম্বা যা আকৃতিতে শরীর থেকে আলাদা। শরীরের উপরের অর্ধেক কালো থেকে গাঢ় নীলাভ-বাদামী রঙের এবং নীচের অর্ধেক হলুদাভ থেকে তীব্রভাবে চিত্রিত। লেজ প্যাডেল আকৃতির এবং গাঢ় দাগ বা বারসহ হলুদ। দেহের নীচের এই হলুদ রঙের জন্যই একে ইয়েলো বেলিড নামে ডাকা হয়। দৈহিক আঁশ ছোট, মসৃণ এবং ষড়ভুজ আকারের; মাথার আঁশ বড় এবং নিয়মিত। বড় চোখের একটি নীলচে-কালো আইরিস আছে।
উপকূল এবং প্রবাল প্রাচীর থেকে দূরে খোলা সমুদ্র এদের আবাসস্থল, ফলে উপকূলের লোকজন সচরাচর এদের দেখতে পান না বলে অনেকেই এই সাপটিকে বিরল প্রজাতির মনে করেন। সাগরের প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের প্রধান খাদ্য মাছ। সাগরের উপরের স্তরে এরা চুপচাপ শিকারের জন্য অপেক্ষা করে এবং নীচ থেকে কোনো মাছ কাছাকাছি আসলেই এরা হঠাৎ আক্রমণ করে থাকে।
হলুদ-পেটযুক্ত সামুদ্রিক সাপ দেহের ভারসাম্য দিয়ে সাঁতার কাটে এবং সামনে ও পেছনে উভয় দিকে যেতে পারে। ডাইভিং, পালানোর এবং খাওয়ানোর সময় তারা প্রতি সেকেন্ডে ১ মিটার পর্যন্ত গতিতে ছুটতে পারে। দ্রুত সাঁতার কাটার সময় তারা কখনও কখনও তাদের মাথা জল থেকে বের করে দেয়। স্থলভাগে এই সাপ সোজা থাকতে পারে না এবং কার্যকরভাবে চলতে পারে না।
এই সাপ সারা বছরই প্রজনন করতে পারে। স্ত্রী ইয়েলো বেলিড একসাথে ২ থেকে ৬টি বাচ্চার জন্ম দেয়, যার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ মিমি। অল্পবয়সিরা যথেষ্ট চর্বিযুক্ত দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মের প্রথম দিন থেকেই শিকার করতে পারে।
এদিকে সৈকতের বালিয়াড়িতে সাপটি দেখার পর পর্যটকরা ছুটে আসেন এর কাছে। অনেকেই তুলেন ছবি বা সেলফি। তবে বিরল প্রজাপতির সাপটি নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই তাদের।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কালো ও হলুদ রঙের সাপটি দেখতে অনেক সুন্দর। আগে কোনোদিন এই সাপ দেখিনি। তাই সাপটির ছবি তুললাম।’
আরেক পর্যটক ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, সাপটি বিষাক্ত কিনা জানি না। কিন্তু সাপটি দেখে সুন্দর।
এদিকে সামুদ্রিক সাপটি দেখার পরপরই ছুটে আসেন সৈকতের লাইফগার্ড কর্মী জয়নাল আবেদীন। তিনি সৈকতের নিরাপদ স্থানে নিয়ে সাপটিকে অবমুক্ত করেন।
জয়নাল আবেদীন বলেন, গেলো এক সপ্তাহে কক্সবাজার সৈকতে ভেসে আসে ৩টি অসুস্থ সামুদ্রিক সাপ। প্রতিটি সামুদ্রিক সাপই ইয়েলো বেলিড। গত বুধবার সৈকতের লাবনী পয়েন্টে একটি এসেছিল; সেটি উদ্ধার করে ফের সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছে। আর সোমবার ১টি সাপকে পর্যটকরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। আর এখন সাপটি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছি। কারণ প্রতি বর্ষা মৌসুমে এই সাপের দেখা মিলছে। যা জানতে পেরেছি, এরা খুবই বিষাক্ত। তাই এ ব্যাপারে পর্যটকদেরও সতর্ক করা হয়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, সৈকতের পর্যটকদের নানা সতর্কতা দেয়া হয়। একদিকে বিচকর্মীরা যেমন মাইকিং করেন, ঠিক তেমনি হোটেল ও সৈকতের প্রবেশদ্বারগুলোতে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে নানা নির্দেশনাও দেয়া হয়। যেহেতু সৈকতে বর্ষা মৌসুমে সামুদ্রিক সাপের দেখা মিলছে; তাই এ ব্যাপারে নির্দেশনার পাশাপাশি মাইকিংও করা হবে। যাতে পর্যটকরা সতর্ক হন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, উপকূল থেকে দূরে বসবাস করে বলেই শুধুমাত্র অসুস্থ বা আহত হয়ে উপকূলে ভেসে এলেই কেবল হলুদ পেটযুক্ত সামুদ্রিক সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উপকূলে ভেসে আসা সাপটি সতর্কতার সাথে নাড়াচাড়া না করলে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং কামড়ের সম্ভাবনা থাকে। এদের বিষদাঁত বা ফ্যাংগুলি বেশ ছোট (১.৫ মিমি) এবং খুব সামান্য পরিমাণে বিষ ঢালতে পারে।
তিনি আরও বলেন, সামুদ্রিক সাপের মধ্যে হলুদ-পেটের সামুদ্রিক সাপ সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। এই সাপ অত্যন্ত বিষধর এবং এতে শক্তিশালী নিউরোটক্সিন এবং মায়োটক্সিন রয়েছে। এনভেনোমেশন বা বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- পেশি ব্যথা এবং শক্ত হয়ে যাওয়া, চোখের পাতা ঝুলে যাওয়া, তন্দ্রা এবং বমি হওয়া ইত্যাদি। এ সাপের একটি গুরুতর কামড় সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপে কামড়ানোর সন্দেহ হলে এমনকি কামড়টি তুচ্ছ মনে হলেও যে কারোরই অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
উল্লেখ্য, সামুদ্রিক সাপের কামড় প্রাথমিকভাবে ব্যথাহীন এবং ফোলা বা বিবর্ণতার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে এই সাপের কামড়ে প্রাণহানির ঘটনা খুবই বিরল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।